তপন কুমার রুদ্রের সাক্ষাৎকার | সাম্য রাইয়ান

তপন কুমার রুদ্রের সাক্ষাৎকার | সাম্য রাইয়ান


২০১০ এর ডিসেম্বরের কোনও এক দিন তপন রুদ্রর বাড়িতে বসার ঘরে, যেখানে তিনি ছাত্র পড়াতেন, সেই ঘরে বসে এই সাক্ষাৎকারটি লিখিতরূপে গ্রহণ করা হয়েছিলো। তপন রুদ্র মুখে বলছিলেন আর সেই বক্তব্য সাম্য রাইয়ান হাতে লিখে নেন।


এভাবেই তৈরি হয় এ সাক্ষাৎকার।

সাম্য রাইয়ান: স্যার, কেমন আছেন?

তপন রুদ্র: শারীরিক দিক থেকে খুব একটা ভালো না থাকলেও মানসিকভাবে ভালো আছি। নতুন প্রবন্ধের বই এর কাজ শেষ। মেলায় প্রকাশিত হবে। খুব ভালো লাগছে।

সাম্য রাইয়ান: আপনি সম্প্রতি ‘দীর্ঘ উপন্যাস’ লেখার ঘোষণা দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে কৌতুহল হচ্ছে।

তপন রুদ্র: উপন্যাস আসলে দীর্ঘই হয়। কিন্তু আজকাল সমাজ বাস্তবতার কারণেই হোক কিংবা অবসরের অভাববোধ থেকেই হোক, লেখক ও পাঠক চায় স্বল্পদৈর্ঘ্যের উপন্যাস। আমার কাছে মনে হয় এগুলো বিস্তৃত কোন গল্প। ছোটগল্পের দৃশ্যপট হয়ে থাকে সীমিত। যেখানে স্থানান্তর কিংবা দৃশ্যান্তর বড় বেশি ঘটে না। কিন্তু উপন্যাসে এটা হওয়া চাইই। ছোট পরিসরেও দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে, এক পট থেকে অন্য পটে অথবা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চরিত্ররা বিচরণ করতে পারে। বিস্তৃত কোনও গল্পের ক্যানভাস যদি একটু বড় হয়, আর যদি থাকে বৈচিত্র্য, আমার মনে হয় তখনই একটা স্বল্পদৈর্ঘ্য উপন্যাস গড়ে ওঠে। আমার বিশ্বাস, এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত আমার উপন্যাস ‘অংশী’ তেমনই একটা স্বল্পদৈর্ঘ্যের উপন্যাস। বর্তমানে যেটা লিখছি, তাকে প্রকৃত উপন্যাসের আঙ্গিক দিতে চাই। সে কারণেই দীর্ঘ উপন্যাস কথাটি ব্যবহার করেছি মাত্র।

সাম্য রাইয়ান: আপনি সাহিত্যের প্রায় সবক’টি শাখাতেই বিচরণ করেছেন। তার মধ্যে কোন শাখায় আপনি বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন?

তপন রুদ্র: হ্যাঁ, আমি সব ধরণের লেখাতেই হাত রেখেছি। তবে কবিতাই আমার প্রথম প্রেম এবং সবচেয়ে প্রিয় মাধ্যম। আমি মনে করি চিত্রশিল্প যেখানে থেমে যায়, কবিতা সেখানেও থামে না। কবিতা এক অনিঃশেষ গন্তব্য; তাই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে একটি লাইন, ‘পৃথিবীর সেরা কবিতাটি আজও লেখা হয়নি।’ এমন অনিঃশেষ যাত্রায় থেকে যেতেই মন চায়। কবিতা শুধু ভালবাসা নয়, একটা চ্যালেঞ্জও বটে। বলার কথাটা অভিব্যক্তিময় করে তুলতে কবিকে নির্ভর করতে হয় হঠাৎ পাওয়া বাক প্রতিমার ওপর। অথবা বহুসাধনায় প্রকৃত শব্দচয়ন এবং উপযুক্ত শব্দবিন্যাসের উপর। আর কবিতা যদি স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়, তখন কবি নিজের সৃষ্ট রূপকল্পে হাবুডুবু খান। এমন আনন্দ আর কোথায় পাবো?

সাম্য রাইয়ান: অনেকদিন পর কুড়িগ্রামে কবিতা চর্চার একটা প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। অনেক তরুণ এই মুহূর্তে কবিতা লিখছেন। বর্তমান তরুণদের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

তপন রুদ্র: নবীন লেখকদের দেখলে আমি আনন্দিত হই। কারণ ওরা আমার বন্ধু হতে পারে। দুই কবি যখন পাশাপাশি বসে তখন কেউ কারো ছোট হয় না - বড়ও হয় না। আমি মনে করি বয়সের ব্যবধানটা ওখান থেকে পালিয়ে যায়। নবীন কবিদের আমি কবিতা শেখাতে চাই না। সেটা সম্ভবও নয়। যেটা প্রয়োজন এবং সম্ভব, সেটা হলো নবীনদের অনুপ্রাণিত করা। সেটা আমি করতে চাই। নবীনদের ভেতরের সম্ভাবনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আমি অনেক সময় চমকে উঠি ওদের ভাবনার গভীরতা, ব্যাপ্তি দেখে। অনেকের শব্দচয়ন, শব্দনির্মাণ এবং বিন্যাস দেখেও আনন্দিত হই। সেই সাথে আমার একটা মন্তব্য আছে, যা কিছু প্রতিষ্ঠিত ও গ্রহণযোগ্য হয়ে আছে তার বাইরেও যারা ভাবেন, সৃষ্টি করেন তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করতেই হবে। আমি মানি না যে, ভবিষ্যতে আর কোনও রবীন্দ্রনাথের জন্ম হবে না। তবে শুধু কবি হবার জন্য যারা কবিতা লেখার চেষ্টা করেন, তাদের ব্যাপারে আমি সাবধান থাকি; বাকি সবাইকেও সাবধান হতে বলি। এটা খুবই আনন্দের ব্যাপার যে, বর্তমানে কুড়িগ্রামে কবিতা চর্চার একটা প্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। অবশ্য কেউ কেউ কবিতাকে ভালবেসে আর জীবনকে শ্রদ্ধা করে কবিতা লেখার কাজে নিয়োজিত। তবে খুব কম হলেও এমন দু’-একজন আছেন যারা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, খ্যাতির মোহে এবং উদ্ভট প্রকৃতির মানুষরূপে গণ্য হবার আশায় কবিতা লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে এরা স্বাভাবিক কারণেই ব্যর্থ। প্রকৃত জীবনবাদী কাব্যচর্চা বৃথা যায় না। আর তার সাথে সৌন্দর্য চেতনা এবং সরল প্রকরণ যুক্ত হলে সেই কবিতা কখনো ব্যর্থ হয় না।

সাম্য রাইয়ান: কুড়িগ্রামের সাহিত্য পত্রিকা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

তপন রুদ্র: আমার দেখা মাত্র দুইটি সাহিত্য পত্রিকা অনেককে সাথে নিয়ে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা স্বীকার করে এগিয়ে যাচ্ছে। এ দু’টির নাম বলতে আমার দ্বিধা নেই। একটি হলো তোমাদের 'বিন্দু’, অপরটি মাইকেলের 'উত্তরের জানালা'। আমি 'অক্ষর'কেও সেভাবেই এগিয়ে নিতে চাই। আর এজন্য তোমার সহযোগিতা আমার দরকার। এখন তো কুড়িগ্রামে অনেককে সাথে নিয়ে নিয়মিত পাঠচক্র বসে না। এটা হওয়া দরকার। তবে দৃশ্যমান অনেক জায়গায়, সে হোক রাস্তার মোড়ে কিংবা কোনও রেঁস্তোরায় খোলামনের তরুণ কিংবা প্রবীণ লেখকেরা গল্পের ফাঁকে চা পান করতে করতে প্রাচীন থেকে বর্তমান পর্যন্ত অনেক সুন্দর আলোচনার অবতারণা করেন। অনেক গভীর ও সুন্দর কথা উঠে আসে সেইসব আড্ডায়। এই দৃশ্য বড়ই প্রীতিকর। ঐ সময়ের কথাগুলো ধরে রাখতে পারলে তা হতে পারে এক মহাকাব্যিক পরিবেশনা।

সাম্য রাইয়ান: কবি বা ঔপন্যাসিক তপন রুদ্রের চেয়ে প্রাবন্ধিক তপন রুদ্র বেশি আদৃত বলে আমার মনে হয়। বিভিন্ন বিষয়ে আপনি প্রচুর প্রবন্ধ রচনা করেছেন, আপনার প্রবন্ধ চর্চার স্বরূপ জানতে চাই।

তপন রুদ্র: আমি এতটুকু বলতে পারি, আমি প্রবন্ধ সাহিত্যকে কিছুটা চিনেছি। প্রবন্ধও কবিতার মতো রসবতী হতে পারে। এর উজ্বল দৃষ্টান্ত বঙ্কিমচন্দ্র রচিত বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বাবু’। সমসাময়িককালে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধ অত্যন্ত সুখপাঠ্য। তবে সাহিত্যের গুণধারী প্রবন্ধ আর পত্রিকায় ছাপা প্রতিবেদন কিংবা নিবন্ধ এক হতে পারে না। পত্রিকার অধিকাংশ নিবন্ধ-প্রবন্ধ একটা কঠিন কালের বলয়ে আবদ্ধ। আজকে যে নিবন্ধ সাধারণ পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে, তার আবেদন মাত্র অল্প ক’দিন পরেই আর টিকে থাকে না। কিন্তু কোনও মননশীল মানবচিন্তা সমাজচিন্তা নন্দনতত্ত্ব কিংবা জীবনদর্শন ভিত্তিক সুলিখিত তথা কাব্যগুণ সম্পন্ন প্রবন্ধ টিকে থাকে অপরিবর্তিত আবেদন নিয়ে। কখনো কখনো অগ্রসরমান সময়েও পুরনো দিনের আদর্শ প্রবন্ধ অধিক আবেদন অর্জন করে। সেই প্রবন্ধকেই বলবো প্রকৃত প্রবন্ধ।

সাম্য রাইয়ান: ‘প্রাক-পরিচয়’ বইটিতে কী ধরনের লেখা স্থান পেয়েছে? বইটির নামকরণ প্রসঙ্গে জানতে চাই।

তপন রুদ্র: আমার সর্বশেষ বই ‘প্রাক-পরিচয়’ সীমিত অর্থে আমার নিজেও একটা পরিচয় হতে পারে। কারণ ’৭০ এর দশকের একেবারে শেষ পর্যায়ে লেখা প্রবন্ধ থেকে আরম্ভ করে বর্তমান বছরের প্রথম মাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লেখা প্রবন্ধগুলো থেকেই বেছে নেয়া ২৩টি রচনাকে এখানে জায়গা দেয়া হয়েছে। একই সময় পরিধিতে লেখা অন্য ১৪টি প্রবন্ধ নিয়ে ২০০৮ সালে ‘সীমানার সাথে যুদ্ধ’ শিরোনামে আমার আরেকটি প্রবন্ধ সংকলন বেরিয়েছিলো। বর্তমান প্রবন্ধ সংকলন ‘প্রাক-পরিচয়ে’ গৃহীত প্রবন্ধগুলো বিশেষ একটি বিষয়ের ভিত্তিতে সূচিবদ্ধ নয়। নানা অনুষ্ঠানের উপর প্রাথমিক আলোকপাত করেছি বিভিন্ন প্রবন্ধে। তাই এর নাম দিয়েছি ‘প্রাক-পরিচয়’।

সাম্য রাইয়ান: গল্প-কবিতা, উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ যে কোনও ক্ষেত্রে, কী ধরনের পাঠক প্রতিক্রিয়া আপনি আশা করেন?


তপন রুদ্র: কেউ তো আর শুধু নিজে পড়ার জন্য লিখে না। আমিও তো লিখেছি পাঠকের জন্য। তারা কীভাবে নেয় সেটা অবশ্যই আমার কৌতুহলের জায়গা। মনযোগ দিয়ে পড়বার ধৈর্য্য পাঠকের কাছ থেকে অর্জন করতে পারলাম কী না, সেটা জানার অপেক্ষায় আমাকে থাকতেই হয়।

সাম্য রাইয়ান: স্যার, আজকের আনুষ্ঠানিক আলোচনা এখানেই শেষ করতে চাই। এখানে বলে রাখি, আরেকদিন আরও দীর্ঘ সময় নিয়ে নানা বিষয়ে আপনার সাথে বিস্তৃত আলোচনা করবার ইচ্ছে আমার আছে। আজ এতক্ষণ সময় দেয়ার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। শুভকামনা আপনার জন্য…

তপন রুদ্র: তুমি যে এত ধৈর্য্য নিয়ে বসে আমার এত কথা শুনলে এবং এত কষ্ট করে এতসব কথা হাতে লিখে নিলে তাতে আমি খুবই আনন্দিত। শুধুমাত্র ধন্যবাদ দিলেই আমার দায়িত্ব শেষ হবে না জানি। বাস্তবিকপক্ষে সময় হাতে নিয়ে এসে আমার কাছে আরো কিছু জানার যে অভিপ্রায় তুমি ব্যক্ত করলে, তাতে আমার দায়িত্ববোধ আরও গভীর হলো। আমি বেশ বুঝতে পারছি আমার কাছে তোমার অনেক দাবি। আমি কতদূর যেতে পারি বা পারি না সেই জন্য তোমাকেও অপেক্ষা করতে হবে। আমি আশীর্বাদ করি, তুমি অনেক ভালো থেকো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?