বাজারমুখী সাহিত্যের বিপ্রতীপ ধারার কবি শুভ্র সরখেলের কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রমাগত অন্ধকারে ডেস্কটপের ছায়া’। বইটির সাদাকালো প্রচ্ছদ দেখলেই কেমন মিষ্টিসিজমের গন্ধ পাওয়া যায়। কবির জীবনের শৈশবকালীন বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ের অজস্র ঘটনা কল্পনা এবং বাস্তবতার যোগসাজশে রচিত ২৭টি কবিতার মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে বইটিতে। এই কবিতার লাইনগুলো যেন কামারের নিরন্তর হাতুড়ির শব্দ। যা পাঠক হৃদয়ে স্ব-বিস্ময় সৃষ্টি করে।
‘বাল্যকালের বায়স্কোপ’ বইটির প্রথম কবিতা। যেটি বয়সের সাথে সাথে পরিসমাপ্ত হওয়া ভ্রান্ত ধারণা গুলো, একইসাথে পূর্বপুরুষের ইতিহাস কিংবা বিশ্বকে জানার পরিধি বৃদ্ধির কথা দিয়ে শুরু হয়েছে। সন্তান যেন বিপথে না যায় সে বিষয়ে প্রত্যেক মায়েরই ভয় থাকে। এই ভয়কে ফুটিয়ে তোলার পাশাপাশি প্রচলিত নিয়মে বড় হওয়ার থেকে মানুষ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে লেখক বলেছেন,
“জুলিয়াস সিজারের নোটবুকে লেখা ছিল,
ভগবানের কোন বিবেক নেই।
আর আমরাতো নেহাতই সাধারণ বান্দা;
তাই কখনো অভিশাপ দিওনা
এই বলে, বাবা অনেক বড় হও।”
পরবর্তী কবিতা ‘দাদু ইমাম বখস’। যার চোখে লেখক স্বপ্ন দেখেন -
“পৃথিবী একদিন কমিউনিজমে পরিণত হবে।”
সময়ের সাথে সাথে যেমন আমরা বয়সে বড় হই তেমনি আমাদের জানার পরিধিও বাড়ে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উপাদানের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ হয় অভিজ্ঞতার ঝুলি। তথাকথিত শ্রদ্ধাবোধে অভ্যস্ত আমাদের পরিবার, দেশ, প্রযুক্তি সর্বোপরি আমরা। কিন্তু কবির প্রেম মজে আছে পুরানো দেয়ালঘড়ি আর সমালোচিত সাহিত্যে। প্রয়োজনে বিপরীত পরিবর্তনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থান পেয়েছে কবির তৃতীয় কবিতায়। যেমন-
“ধর্ম কুসংস্কার হয়ে ওঠে
বেশ্যা বিখ্যাত হয়ে ওঠে”
আমাদের সত্ত্বা, নিয়ম কিংবা সম্ভাবনা নেই। আমাদের ইতিহাস এবং সম্ভাবনা ঋণে পাওয়া নকশি চাদরে ঢাকা। মানবাধিকার অথবা স্বাধীনতা - এ ধরণের কোনকিছুকে উদ্দেশ্য করেই সম্ভবত কবি রচনা করেছেন তার কবিতা ‘পাশ্চাত্যের মাটিতে উর্বর শেকড়’। এরপরেই ‘অসুস্থ’ কবিতায় কবি প্রজন্ম ভেদে মানুষের চিন্তা ধারার অসংগতি খুব সাবলীল ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন,
“৯২ সালের কোর্স করে তারা
যে সার্টিফিকেট পেয়েছিল
সেই সার্টিফিকেট আমাদের
জন্মগত প্রাপ্তি। যে প্রাপ্তি
তারা সহজে মেনে নিচ্ছে না।”
ভালো সময়ে অনেককেই পাওয়া যাবে। কিন্তু বিপ্লবের মিছিলে সাথে থাকবে একদল অপরিচিত মুখ। যাদের কথা তিনি ‘গ্রহণ মিছিল’ কবিতায় বলেছেন। স্বাভাবিক গতিময়তায় লিখতে লিখতেই অপ্রত্যাশিত কিছু সৃষ্টিকর্ম হয়ে যায়। সে কথাই উঠে এসেছে ‘অনাথ’ কবিতায়। আর ‘একটা চিরকুট’ কবিতায় ভবিষ্যতের চিন্তায় বর্তমানকে পিষে নষ্ট করার উদাহরণ দিতে গিয়ে কবি মঙ্গলে হায়ারোগ্লিফিকের হাহাকার চিত্রে বিচরণ করেছেন। চাদরে লুকায়িত আমাদের ইতিহাস সত্ত্বা এবং সম্ভাবনার কথা উঠে এসেছে ‘আড়াল’ কবিতায়। কখনো কখনো থমকে গেলেও থেমে থাকে না জীবন। জীবনের এই গতিময়তাই বর্ণিত হয়েছে “অভাবের দিনে আপত্তি থাকতে নেই” কবিতায়। দিনে দিনে সভ্যতা, সংস্কৃতির পরিবর্তন খুব সাধারণ ব্যাপার। যার প্রভাব রয়ে যায় ব্যক্তির পুরো জীবনে। কবি বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার শৈশবকালের তুলনা করে ‘পরিস্থিতি’ কবিতায় বলেন-
“জন্মের পর তুমি শুনেছ
মোবাইলের রিঙটোন;
যেখানে আমি শুনেছি
ভরা মহলে বেদের মেয়ে জোৎস্নার ক্যাসেট।”
বিচিত্রময়তায় পরিপূর্ণ জীবন। কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়। সবকিছু মানিয়ে নিয়ে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে হয় আমাদের। আবার কখনও কঠিন পরিস্থিতিকেও স্বাভাবিকভাবে সামলে নিতে হয় সামাজিকতার দায়বদ্ধতা থেকে। কবি তার ‘স্নিগ্ধার অপমৃত্যু’ কবিতায় লিখেছেন-
“অসহ্য সামাজিকতা যখন আমার
বিবেকের জমিতে নীল চাষ করতে চায়”
মানুষের প্রচলিত জীবন প্রবাহ এবং সাম্প্রতিক অবস্থা প্রতীকি অর্থে উপস্থাপিত হয়েছে ‘অশেষ বিশেষ ধন্যবাদ’ এবং ‘অপরিকল্পিত ঘোষণায় এক যুবকের জন্ম’ কবিতায়। আমাদের জীবনে যা ঘটে, তাইই তো সাহিত্য। সাহিত্যের আশ্রয়ে আমাদের জীবনের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আর সাহিত্যের একটি অন্যতম অংশ হল কবিতা। কবি তার কবিতা ‘খোশগল্প-২’ এ বলেন,
“পেটের যে কথাগুলো আড্ডাতেও বেড়োয় না,
তা কবিতার শেষ লাইনে পাওয়া যায়।”
সুবিধাবাদী মহল চিরকালই হীনমন্যতায় আবদ্ধ থেকে বাহিরের রূপ বদলিয়ে কালের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। ‘সত্ত্বা চেয়ে থাকে হীন মন নিয়ে’ কবিতায় কবি এর বাস্তব উদাহরণ স্থাপন করেছেন। যথা,
“কত মিথ্যে এখনো বয়ে বেরায় ’৫২!
গ্রাম্য রাজাকার এখনো মুক্তিযোদ্ধার সনদে
চেয়ারম্যান হয় নির্দ্বিধায়!”
আর ‘ক্রমাগত অন্ধকারে ডেস্কটপের ছায়া’ অর্থাৎ যে কবিতার নামে বইটির নামকরণ করা হয়েছে সেটি পারিপার্শ্বিকতা মেনে নিয়ে মানুষ হবার সংগ্রাম। মা ও মাটিকে সম্বোধন করে ‘আপত্তি’ কবিতার মাধ্যমে বইটির সমাপ্তি হয়েছে।
মহাভারতে মহাদেবের তাণ্ডবনৃত্য, আমাজন হতে চিরহরিৎ বন, পলাশীর ময়দান, কাল মার্কস, জুলিয়াস সিজারের নোটবুক, হিরোশিমা-নাগাসাকি, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কিংবা চে গুয়েভারার সমাজতন্ত্র, জাহানারা ইমাম এবং বিডিআর বিদ্রোহ - কী নেই শুভ্র সরখেলের রচনাবলীতে! ইতিহাস, দর্শন, প্রকৃতি ও সাহিত্য সব কিছু থেকে নির্যাস এনে কবি শব্দবন্দী করেছেন তার ‘ক্রমাগত অন্ধকারে ডেস্কটপের ছায়া’ নামক কাব্যগ্রন্থে। যাতে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে গ্রিক মিথোলজির চমৎকার ব্যবহার। যা পাঠক হৃদয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করে কিংবা নিয়ে যায় কোন নির্বাসিত দ্বীপে। আর কবিতায় দুর্দান্ত সব শব্দচয়ন কবির শক্তিশালী কবিসত্তার বহিঃপ্রকাশ। তবে কোন কোন কবিতার কিছু অংশ সাধারণ পাঠকের কাছে একটু দুর্বোধ্য বলে মনে হয়। যেমন ঈশ্বর-২, ঈশ্বর-৩, অগাষ্টের ১৭ ইত্যাদি।
রাশেদুন্নবী সবুজ কর্তৃক বাঙ্ময় প্রকাশনা থেকে বইটি ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত হয়। লেখক এটি উৎসর্গ করেছেন কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার টেকনোলজি বিভাগের জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর আসিফ ইকবাল টমাসকে। যাকে লেখক তার চোখে দেখা একজন মানুষ হিসেবে অবিহিত করেছেন। সংগৃহীত স্কেচ অবলম্বনে বইটির প্রচ্ছদ করেছেন সাম্য রাইয়ান। যার বিক্রয়মূল্য ২৫ টাকা মাত্র।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?