কুড়িগ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আহসান হাবীব জুলকারনাইন কয়েকযুগ ধরে সত্য ও সুন্দরের চর্চা করে চলেছেন। প্রচলিত অপমূল্যবোধ ভারাক্রান্ত পরিপার্শ্বকে পরিশুদ্ধ করার এক কঠিন সংগ্রামে নিরলসভাবে কাজ করছেন। তাঁর কর্মক্ষেত্র কুড়িগ্রাম হলেও আগ্রহ সমগ্র উত্তরবঙ্গকে নিয়ে। এই অঞ্চলের নদীবিধৌত, নদীনির্ভর ও নদীভাঙা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য তিনি বুকের গভীরে এক প্রবল ভালবাসা বহন করেন। কর্মচেতনার নিরন্তর চর্চাকে ধারাবাহিক রাখার জন্য তিনি আশ্রয় করেছেন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে। কর্মীর ঘামে ভেজা শ্রম দিয়ে পথ দেখিয়ে চলেছেন বিপর্যস্ত সমকালের দিশাহীন পরিব্রাজকদেরকে। চারপাশের ঘটনাবলীর দুর্মর অভিঘাত তাঁর মনে বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি করে। তাই তিনি সাহিত্যের আশ্রয় নেন। জীবনের সহিত যাহা তাহাই তো সাহিত্য। লেখক প্রাত্যাহিক যাপিত জীবনের অন্তরালে যা দেখেছেন, তা বাঙ্ময় করে তুলেছেন তাঁর 'অতলে জীবন' গল্পগ্রন্থে। এই গ্রন্থের পাঁচটি গল্প এক অনিবার্য বাস্তবতার বীভৎস রূপ নিয়ে আমাদের সামনে মুখব্যাদান করে উপস্থিত হয়। আমরা চমকিত হই; উৎকট আত্মচিন্তা প্রদর্শনে আতংকিত হই; আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের অস্তিত্বের অবয়বকে প্রকট নখরে ছিন্নভিন্ন-টুকরো টুকরো করে; পরিশেষে আর্তচীৎকার ছাড়া আত্মমূর্তির কিছুই আর অবশিষ্ট রাখতে পারিনা।
আহসান হাবীব জুলকারনাইন এর "অতলে জীবন" গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প "উত্তরের চর"। কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্রের কোলে জেগে থাকা চরাঞ্চলের উত্তরে অবস্থিত কোন একটি চরের বাসিন্দা আইয়ুব মিয়া এই গল্পের প্রধান চরিত্র। তাকে ঘিরে সক্রিয় থাকা মানুষ আর ঘটনাপ্রবাহ এই গল্পের কাঠামোর অনুসঙ্গ। অর্থকষ্টপীড়িত জীবনে মাছ ধরা তার প্রধান পেশা। কিন্তু দিনে দিনে নদীর জলপ্রবাহ কমে যাচ্ছে। নদীতে আর তেমন মাছ পাওয়া যায় না। সারারাত নদীতে জাল বিছিয়েও পর্যাপ্ত মাছ ধরা পরে না। এ ঘটনা শুধু আজকের নয়। বছরের পর বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন আইয়ুব মিয়া সন্তানদের পেট পুরে দুটো ভাত খাওয়াতে পারে না। তার কাছে নদীকে আর প্রেমিকা বা বন্ধু বা মাতা মনে হয় না, মনে হয়- “নদী তো না য্যান এক সর্বনাশা রাক্ষুসি"। রোমান্টিক বিহ্বলতা নয়, এক কঠোর বিপর্যয়কে বয়ে নিয়ে আসে বালু জমে ছোট ও জলশূন্য হয়ে যাওয়া নদীর ঢেউ। সে লক্ষ্য করে নদীর জল নষ্ট হয়ে গেছে; শরীরে লাগলে চুলকায়।
প্রাকৃতিক নিষ্ঠুরতার করুণ শিকার আইয়ুব মিয়া প্রশান্তির জন্য নিজের মনের উপর নির্ভর করে। প্রকৃতির ভয়ংকর রূপের আড়ালে যে এক অপার সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে সেই প্রতিচ্ছবি তার দৃষ্টি এড়ায় না। প্রকৃতির সৌন্দর্য আস্বাদন তার নিকট বিলাসিতা মাত্র। অনিবার্য বাস্তব তার সার্বিক সত্যতা বয়ে এনে সামনে দাঁড়ায়। উদরপূর্তির জন্য সময় না দিলে চলে কী? দুটো কথা বলার জন্য আশেপাশে তখন সে মানুষ খোঁজে। পাশের আর একটি নৌকায় মাছ শিকাররত রহিমুদ্দি'র সাথে সুখ দুঃখের আলাপ করে মনের ভার হালকা করতে চায়।
এই গল্পের আর এক অভাবী মানুষ রহিমুদ্দি। একই চরে তাদের বসবাস; একই নদীর সম্পদ তারা একই অধিকারে ভাগাভাগি করে নেয়। মাছ ধরা নিয়ে তাদের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতা নেই; বরং জালে মাছ না পাওয়া নিয়ে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা আছে। একে অপরের নিকট নিজেদের সাংসারিক দুর্বলতা-সীমাবদ্ধতার কথা প্রকাশ করে বুকের চাপ কিছুটা হালকা করে নেয়। সকাতরে রহিমুদ্দি যখন বলে অভাবের কারণে সে সওদাপাতি করতে গত হাটে যেতে পারে নি; সারা সপ্তাহ তার সন্তানেরা প্রায় অভুক্ত থাকবে; তখন আইয়ুব মিয়ার বুক থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে আসে।
আলোচ্য গ্রন্থের আর একটি গল্প "অতলে জীবন"। এই গল্পটির নাম দিয়েই গ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে। তাই এই নামগল্পটির প্রতি আমাদের আগ্রহ ছিল সর্বাধিক। লেখক পাঠককুলকে নিরাশ করেননি।
গল্পের প্রধান চরিত্র একজন দারিদ্র্যপীড়িত অভাবী মানুষ। নাম তার সুরুজ আলী, কিন্তু সূর্যের দীপ্তি তার জীবনে অনুপস্থিত; বরং মেঘের ঘনঘটা তার জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সুরুজ আলীর স্ত্রীর ভাষ্যে গল্পটি শুরু হয়। সাতদিন ধরে একটা ঘন কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে তাদের মাথার উপরে ঝরে পরছে। ঘরে মজুদ খাবার ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তিনদিন ধরে সপরিবারে তারা না খেয়ে আছে। স্বামী স্ত্রী না হয় কষ্ট সহ্য করতে পারে, কিন্তু ছোট শিশুরা তো পারে না।
বর্ষাকালের টানা বৃষ্টিতে বন্যা শুরু হয়ে গেছে; মাঠ ডুবে গেছে হাটু জলে। নদী-নালা-খাল-পুকুর সবকিছু থেকে জল উপচে পড়ছে। এরই মধ্যে অনাহারী দুর্বল শরীর নিয়ে সুরুজ মিয়া এগিয়ে যায়। সাঁতরে খাল পার হয়, হাটুজল ঠেলে কষ্টেসৃষ্টে এসে হাজির হয় কাদের মোল্লার বাড়িতে। তাকে দেখে কাদের মোল্লা খেকিয়ে ওঠে - “ওই, এই ঝড়-বাদলের দিনে তুই এই হানে ক্যান? তামাশা দেখাইতে আইছস নাকি? যত্তসব বেজন্মার দল"। সুরুজ আলী করুণ স্বরে তার দুর্দশার কথা জানায়। কিন্তু কাদের মোল্লার মন গলে না; বরং তার দারিদ্রকে ব্যঙ্গ করে ঝটকা দিয়ে পা ছাড়িয়ে নেয়।
অপমানের ঢেউ থেকে বাঁচতে সে দৌড়ে পালাতে চায়। অনাহারে ক্লিষ্ট-শ্রান্ত শরীর, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ব্যথিত সুরুজ আলী তাল সামলাতে পারে না। এক অপার্থিব মহাকালের পাড়ে এসে অথৈ জলে পড়ে যায় সে। "অথৈ পানিতে তলিয়ে যেতে যেতে সুরুজ আলীর মনে একটা ছবি ভেসে ওঠে। সে তলিয়ে যাচ্ছে, তার জীবন, স্বপ্ন, সংসার সবই তলিয়ে যাচ্ছে, যেমন তার বাপদাদারাও তলিয়ে গিয়েছিল।"
গল্পগুলির চরিত্র চিত্রন বিষয়ে আলোকপাত করলে বোঝা যাবে শক্তিশালী ও উজ্জ্বল চরিত্র বর্ণনায় লেখকের সাফল্য কেমন ছিল।
অতলে জীবন |
একই গল্পের রহিমুদ্দি, দেলোয়ার নিজ নিজ চারিত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আক্রমণাত্মক ও লোভী সমাজের করুণ শিকার তারা। লেখক সুনিপুণ হাতে চরিত্রত্রয়কে তাদের অবস্থান অনুযায়ী জীবন্ত করে তুলেছেন। রহিমুদ্দি যখন আক্ষেপ করে তখন লেখক লক্ষ্য করেন আইয়ুব মিয়ার বুক থেকেও দীর্ঘনিঃশ্বাস বের হয়ে আসে।
'নিস্তরঙ্গ' গল্পের প্রধান চরিত্র 'করিমুদ্দি'। সে দারিদ্রের ভারে কাবু হয়ে গেলেও মচকে যায়নি। অর্থনৈতিক দৌর্বল্যকে পরিবর্তন করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা তার বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সে জানে বৎসরের সব দিন সমান যায় না। তাই আগাম সতর্কতা হিসেবে বাড়ির চারপাশের পতিত জায়গায় বিভিন্ন শাক-সবজির আবাদ করে। সে জানে প্রয়োজনে এই সবজিগুলোই তার মুখে দু'মুঠো অন্ন যোগান দেবে। হাটের ফড়িয়া বা পাইকারদের কারসাজিতে তার উদ্দেশ্য সফল হয় না। কিন্তু তবুও সে পরাজয় স্বীকার করেনি। সাতকেজি বেগুন বিক্রি করে মাত্র সাত টাকা পেলেও তার পদক্ষেপ দৃঢ় থেকে যায়। হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে নির্ভার মনে যাত্রা করার সাহস তার রয়েছে। লেখক করিমুদ্দির চরিত্র অংকনে কোনরকম কার্পণ্য করেননি। তার মধ্যে অসহায়ত্বের সামান্য চিহ্ন কোথাও নেই। অভাব তো থাকবেই, কিন্তু তাই বলে হার স্বীকার করতে হবে কেন? ভাতের অভাব সবজি দিয়ে দূর করার বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ তার রয়েছে। সন্তানের মুখ চেয়ে সে হয়তো প্রতিবাদী হতে পারে না। কিন্তু আত্মসমর্পণের গ্লানি তার পরাজয়ে নেই। বরং পাইকারদের প্রতি এক নীরব ঘৃণা তাকে স্বচ্ছল আগামীর দিকে এগিয়ে করে নিয়ে যায়।
‘অতলে জীবন' গল্পের 'সুরুজ আলী' এই গল্পগ্রন্থটির একটি বিশেষ চরিত্র। সে যথারীতি দরিদ্র। কিন্তু সে সহানুভূতিশীল, আন্তরিক। স্ত্রী-পুত্রের প্রতি তার ভালোবাসা প্রশ্নাতীত।
সুরুজ আলী দরিদ্র হতে পারে কিন্তু আত্মসম্মানহীন নয়; অপমানের মুখে দাঁড়িয়ে সে আত্মসমর্পণ করে না। দুমুঠো চাউল সংগ্রহের জন্য তার কাতরতা প্রশ্নাতীত, কিন্তু সেজন্য নিজের মানমর্যাদা বিকিয়ে দিতে রাজী নয়। তার অনাহারক্লিষ্ট শরীর শক্তিহীন কিন্তু মানসিকভাবে সে অশক্ত নয়। প্রকৃতির করাল থাবায় যখন তার শারীরিক অস্তিত্ব বিপন্ন হতে থাকে, তখনও তার মন জীবন্ত থেকে যায়। মরণোন্মুখ মুহুর্তেও অতীত ইতিহাসের আলোয় ভবিষ্যতের সমাধান ভাবতে থাকে। খুঁজতে থাকে আলোর পথরেখা।
গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্পটি (উত্তরের চর) শুরু হয়েছে একটি রহস্যময় ঘটনার আশংকাযুক্ত সংলাপ দিয়ে।
“ক্যাডা যায়? আরে কই, ক্যাডা যায়? কথা কও না ক্যান? কোন চরে যাইবা?”
এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া এই প্রশ্নমালার উত্তর আমরা তাৎক্ষণিকভাবে পাইনা। আমাদের কাহিনীর গভীরে ঢুকে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
যে কোন গল্পের অতীব প্রয়োজনীয় উপাদান হল সংলাপ। আলোচ্য গল্পেও তাই সংলাপে ভর করে কাহিনি এগিয়ে যায়। দেলোয়ারের সাথে আইয়ুব মিয়ার সংলাপ সমকালীন বাস্তব অবস্থাকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে। আমরা একের পর এক অনিশ্চয়তার দরজা খুলে গল্পের ভিতরে প্রবেশ করতে থাকি।
‘নিস্তরঙ্গ' গল্পটিও শুরু হয়েছে উদ্বিগ্ন পিতা করিমুদ্দির সংলাপ দিয়ে। পুত্রের প্রতি তিনি আহ্বান করছেন -
"আরও জোরে পা চালারে বাজান, হাডের বেলা যায়গা।"
পুত্রের সাথে পিতার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়ে যেতে থাকে। খানিক বর্ণনা শেষে আবারও একগুচ্ছ সংলাপ ভবিষ্যতের দুর্ভাগ্যকে মূর্তমান করে তোলে।
সংলাপবহুল গল্প 'জাত'। এই গল্পে বাবুলাল, বাসন্তী ও আকরাম তিনজনই সরব কণ্ঠে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। সংলাপমুখর এই গল্পের চরিত্র চিত্রনে লেখক বর্ণনার চাইতে বেশি নির্ভর করেছেন পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের উপর।
'অতলে জীবন' গল্পটিও শুরু হয়েছে সংলাপ দিয়ে। স্ত্রীর কাতর অনুরোধ পাঠকের হৃদয়ে করুণ সুরের সৃষ্টি করে। পাঠক সহানুভূতির প্রশ্রয় নিয়ে গল্পের আঙ্গিকের সাথে একাত্ম হতে থাকে। সুরুজ আলির সাথে সাথে পাঠকের হৃদয়ের তন্ত্রীও মোচড় দিয়ে ওঠে যখন ছেলেটা ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে ডুকরে কেঁদে ওঠে বলে-
"মা রে, আমার বুকটা ক্যামন করতাছে, আমারে ধরো মা, আমারে ধরো।"
এই গল্পের আরেকটি প্রধান চরিত্র কাদের আলিকে বিশ্লেষণ করতে লেখক একটিও বর্ণনামূলক বাক্য ব্যয় করেননি। বরং কাদের মোল্লা নিজ ভাষ্য দিয়েই নিজের আক্রমণাত্মক, ধর্মকেন্দ্রিক, হিংসুটে, লোভী চরিত্র পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন। আমরা তার নিজের ও অন্যদের বক্তব্য শুনেই বুঝতে পারি সমাজে এই ধরণের মানুষ বিরল নয়।
কাদের মোল্লা সম্পর্কে সুরুজ আলির মন্তব্য -
"হ দান করে ঠিকই, কিন্তু হেইডা নাম কামানোর লাইগা, লোক দেখানো দান।"
কাদের মোল্লার নিজস্ব ভাষাভঙ্গী-
# “যত্তসব ফাতরামো কথা। শোনো ছফু মিঞা, তুমি মনে করছ দুই ক্লাশ পইরা বিদ্যার জাহাজ হইছ।"
# “তামাশা দেখাইতে আইছস নাকি? যত্তসব বেজন্মার দল"
বাংলা ভাষার সমকালীন লেখকদের আগ্রহ মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের টানাপোড়েন অংকনে । অস্তিত্ববাদী এই সময়ে উত্তরাধুনিক লেখকদের এই মনোভঙ্গীর বিপরীত দিগন্তে আহসান হাবীব জুলকারনাইনের অবস্থান। সহজ শব্দ এবং সরল বাক্যকে আশ্রয় করে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি। কুড়িগ্রামের মানুষ তিনি। কিন্তু এমন এক জনপদের জীবন কাহিনী তিনি গল্পগুলোতে বিবৃত করেছেন যারা নাগরিক কথকথায় প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়। গল্পের চরিত্রগুলোর মুখের ভাষা হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছেন কুড়িগ্রাম জেলার একেবারে পূর্বপ্রান্তের ভাষা। সে অঞ্চলের মানুষরা কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক কামরূপী ভাষা ব্যবহার করেন না। বরং ময়মনসিংহ জেলার ভাষার সাথেই এর মিল বেশি। যথাযথ দৃশ্যপট তুলে আনার জন্য ওই অঞ্চলের ভাষার প্রামাণ্যতা রক্ষার্থে তিনি যে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ছিলেন তা বলাই বাহুল্য। বস্তুত আলোচ্য গল্পগ্রন্থে লেখক দরিদ্র, অর্থকষ্টপীড়িত, নদী নিপীড়িত মানুষের জীবন ও তৎসংলগ্ন পরিবেশের চিত্র অংকনে যে সামর্থ দেখিয়েছেন, তা অতীব প্রশংসাযোগ্য।
লেখক নিঃসঙ্কোচে দুর্গাপূজা, কালীমন্দির ও পূজা উপলক্ষে বসা মেলার বিস্তারিত বর্ণনা দেন। বার মাসে তের পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে যে মেলা বসতো, তা আজ নানারকম আগ্রাসনে বিপন্ন প্রায়। শুধু সামাজিক জীবনে নয়, বাংলা সাহিত্য থেকেও পূজাকেন্দ্রিক এই মেলাগুলোর উৎসব-হুল্লোড় হারিয়ে যাচ্ছে। লেখকের মানবিক মন এই বিষয়টা নিয়ে সতর্ক, তাই আবহমান কালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করেননি। তাই তো 'হাইটালি' আলেখ্যতে করুণা মাসীর কথা ভেবে কাজল আপ্লুত হয়ে পরে। কালীপূজার মেলা থেকে পরানবাবুর ধুতি কেনার কথা ভেবে সে স্বপ্নকাতর হয়ে পরে।
তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখকের সাহিত্যবোধ কোন ধারার বৈশিষ্ট্য ধারন করে, তা নির্ধারণ করতে গিয়ে আমাদের অবাক হতে হয়েছে। আপাত দৃষ্টিতে গল্পগুলোর কাহিনী চেতনায় তিনি মার্ক্সবাদী আদর্শকে গ্রহণ করেছেন বলে মনে হয়, কিন্তু অন্তর্লোক বিশ্লেষণে দেখা যায় বাস্তবতাবাদ এবং অস্তিত্ববাদ এর প্রভাব খুবই প্রকট। লেখক অনায়াস সক্রিয়তায় একাধিক গল্পে খেটে খাওয়া মানুষের মানসিক যন্ত্রণাকে লিপিবদ্ধ করেছেন। কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চাতুরী নয় কিংবা সুতীব্র আবেগের কৃত্রিম আস্ফালন নয়, বরং তিনি নির্মোহ অবস্থান থেকে সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রামের চিত্র এঁকেছেন। ব্যক্তি মানুষের সক্রিয় জীবনবোধ কোনক্রমেই বিমূর্ত ভাববাদী বিষয়ের কেন্দ্র হতে পারে না, একথা লেখক মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন বলেই মনে হয়। আবার সেই ব্যক্তি মানুষটি যদি হয় সমাজের প্রান্তিক শোষিত শ্রেণীর প্রতিনিধি এবং শোষক শ্রেণী যদি হয় ধনিক ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণীর যথাযথ চিত্রায়ন তাহলে লেখকের চেতনাকে মার্ক্সবাদী বলা ছাড়া উপায় থাকে না। আবার যদি সেই শোষিত শ্রেণীর সংগ্রামী চেতনার বহিঃপ্রকাশ আত্মকেন্দ্রিক ও সমাজ নিরপেক্ষ রসে জারিত থাকে তাহলে তাকে অস্তিত্ববাদী দর্শনের লালন হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়। আর সামগ্রিকভাবে যদি লেখক কোন একটি অবস্থানে নিজের পক্ষপাত নির্দিষ্ট না রেখে ব্যক্তিনিরপেক্ষ নির্মোহ দৃষ্টিকে আশ্রয় করেন এবং কাহিনি বর্ণনায় ভাববাদীতার চাইতে বাস্তবতার আনুগত্য অপেক্ষাকৃত বেশি প্রাধান্য পায়; যে বাস্তব আবার ফটোগ্রাফের প্রতিরূপ নয়, সে ক্ষেত্রে লেখককে বাস্তবতাবাদী বলাটাই শ্রেয়। আসলে সামগ্রিক গল্পকাঠামোগুলোতে লেখক একাধিক সাহিত্য চেতনার মিশেল অনায়াস দক্ষতায় ঘটাতে পেরেছেন বলেই মনে করি। সুক্ষ্ম বিচারে প্রতীকবাদ ও কলাকৈবল্যবাদের কিছু চিহ্ন গল্পের আঙ্গিকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, তবে তা এই মুহূর্তের আলোচ্য নয়।
কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের দরিদ্রতম প্রান্তিক জেলা। প্রতিবেশের অবহেলিত মানুষের চিত্র নিয়ে একটি শক্ত কাঠামোবদ্ধ, বর্ণনাবাহুল্যবর্জিত, সংলাপমুখর গল্পগ্রন্থ রচনা করে আহসান হাবীব জুলকারনাইন তাঁর কল্পনা-ঐশ্বর্যের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গল্পে আভিজাত্যের আস্ফালন নেই, নেই মধ্যবিত্তের দুঃখবিলাস; বরং রয়েছে শহরের কৃত্রিমতা থেকে বহুদূরে নিভৃত পল্লীতে বসবাসরত মানুষদের রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে পুড়ে যাওয়া যাপিত জীবনের প্রাত্যাহিক দীর্ঘশ্বাস, হাহাকার।
সংক্ষেপিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?