কবিতা, কবির বলা গল্প - আশরাফ রাসেল

কবিতা, কবির বলা গল্প - আশরাফ রাসেল

“শুভ্র সরখেল তথাকথিত পাঞ্জাবীওয়ালা কবি না।” তিনি তার কবিতায় বাস্তবতার শক্ত আঘাতে কবিতার ভাষাকে দিয়েছেন বলিষ্ঠ প্রাণ। তার কবিতায় শব্দের সাথে শব্দের, বর্ণের সাথে বর্ণের সংঘর্ষে জ্বলে উঠেছে যে আগুন, তার অবয়বে জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও মানবতার মুখোশের কৃত্রিম মুখচ্ছবি। 


২৭ কবিতার এই কাব্যগ্রন্থটি রাশেদুন্নবী সবুজ কর্তৃক বাঙ্ময় প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ২০১২ সালে। সংগৃহীত স্কেচ নিয়ে প্রচ্ছদ করেছেন সাম্য রাইয়ান। বিনিময় মূল্য ২৫ টাকা। 


কাব্যগ্রন্থের সব ক’টি কবিতা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে লক্ষ্য না করলে কবির ভাব এবং কবিতাকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। সাধারণ পাঠকের কাছে এটি দুরূহ ব্যাপার হতে পারে। তাঁর কবিতায় আধুনিক কবিতার সিদ্ধপুরুষ জীবনানন্দ দাশের মতো ইতিহাস, দর্শনের বা দার্শনিক উপমা দিতে দেখা গেছে। আমেনহোটেপের মমি, ইখাটনের স্মৃতি, কিউনিফর্মের কালি, সম্রাট হামুরাবির ভঙির আইন কিংবা জাহানারা ইমামের আন্দোলন, বিডিআর বিদ্রোহ, বেহুলা, বিবি খাজিদা অথবা রহিম ব্যাপারীর হাট, চে গুয়েভারার সমাজতন্ত্র প্রভৃতি শব্দ চয়ন তার সাক্ষ্য বহন করে। জীবনানন্দ যেমন তার কবিতায় টেনেছেন বিদিশা, শ্রাবস্তী এমনকি হিটলারের কথা। কিন্তু জীবনানন্দের উপমায় এক অন্য ধরনের গভীর মোহ, মাধুর্যতা কাজ করে যা শুভ্র সরখেলের এ কবিতাগুলোয় আমার উপলব্ধি হয় নি। তা  নিশ্চয়ই স্বাভাবিক বটে।


কবি তার ‘অপরিবর্তনীয়’ কবিতায় একজন কলুষিত ব্যক্তির ধর্মের খোলসে, সদম্ভে আত্ম-গৌরবের নির্মম সত্য কাহিনী প্রকাশ করেছেন গভীর বেদনা বুকে নিয়ে, ব্যক্তির আত্মকথনের মধ্য দিয়ে। যেন তার আর কিছুই করার নেই বলেই কবি কবিতা লিখে তার দায় মুক্তি নিচ্ছেন নিজের কাছে নিজেই। কবি দেখছেন, কলুষিত হয়েও এক রাজাকার, পাপী হজ্জে যাচ্ছে শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য। যেন সে পরবর্তী ইলেকশনে নিজেকে হাজী বলে পরিচয় দিয়ে নিষ্পাপের সার্টিফিকেট নিয়ে নিজের ফায়দা লুটতে পারে। এবং তারপর, স্বঘোষিত রাজাকার হয়েও একদিন ঠিকই মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষাকর্তাও হবে। কিন্তু কিইবা করতে পারছেন কবি, শুধু দেখে যাওয়া, সয়ে যাওয়া ছাড়া? অথবা সমাজই বা কী করছে তার? যেখানে 


‘গ্রাম্য রাজাকার এখনো মুক্তিযোদ্ধার সনদে চেয়ারম্যান হয় নির্দ্বিধায়?’


‘অনাথ’ কবিতায়ও কবি দেখেছেন তেমনি আরও এক দৃশ্য, অন্য রকম। যা দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়েছেন, কলম তার থেমে গেছে। হারিয়ে ফেলেছেন ভাষা। চরের কাঁশিয়ার চালা আর বাঁশের ভাঙা বেড়ার ফাঁকে কবির দৃষ্টি যে সর্বশান্ত হল, সে দৃশ্য কবির কবিত্ব জাহির করার ক্ষমতা দেয় নি। কবি কেন থমকে গেলেন? কবি তার কবিতার চরণে হঠাৎ এক বিস্ময়ের চিহ্ন রাখলেন যেন।

‘স্নিগ্ধার অপমৃত্যু’ কবিতায় কবি স্নিগ্ধার কাছে তথা প্রেমিকার কাছে প্রেমের জন্য, ভালোবাসার জন্য আকুতি, আর্তনাদ করেছেন। কিন্তু স্নিগ্ধার বিদায় অথবা কবির সঙ্গ ত্যাগকে কবি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। অথচ কী নির্মমভাবে স্নিগ্ধা কবিকে ফেলে রেখে চলছে দূরে কোথায়, যা কবির কল্পনায় তার স্থান নির্ণয় করতে পারেনি কোনদিন। কবি তখনো ভাবছেন "হয়তো কোন ভুল অথবা অপরাধের দায়ে স্নিগ্ধা তাকে ছেড়ে যাচ্ছে।” যে কী না কোনদিন কবির বাহু ছাড়া, পরম সোহাগ ছাড়া ঘুমাতে পারেনি তার কথা ভেবেই তিনি যেন অস্থির হচ্ছেন বেশি, নিজের চেয়ে।


ভুমিকায় কবি লিখেছেন, 


‘এই বইটি আমার ফেলে আসা অন্ধকারের মূল্যায়ন মাত্র।’


 ‘পরিস্থিতি’ কবিতাতেও তিনি ব্যক্ত করেছেন অনুরূপ ভাবনা। ফেলে আসা অতীতের অন্ধকারকে তিনি ভবিষ্যতের অন্ধকার বলেছেন; যার জন্য আজ তিনি কবি। তিনি মনে করেন, কবি হতে চাওয়া বুঝি তার জীবনের ভুল সিদ্ধান্ত। লিখেছেন-


 “...কবি হওয়া

আমার অন্ধকার ভবিষ্যতের

প্রস্তাব।”


মোটকথা, তিনি যে বলেছেন, এ বই তাঁর অন্ধকারের মূল্যায়ন এবং তার আদলে বইটির নামকরণ, তার মান তিনি রাখতে পেরেছেন।


কবি মানবতার, কবি মানুষের। কিন্তু মানুষ আর মনুষ্যত্ব কোথায় দাঁড়িয়েছে আজ! কোথায় আজকের সমাজ? এ সমাজ এভাবে কতদিন চলতে পারবে, মনুষ্যত্বহীন হয়ে? তার জন্য কবি সংগ্রামের কথা বলেছেন। বলেছেন-


“আমাদের এবারের সংগ্রাম

মানুষ হবার, যতটুকু সম্ভব।”


অথচ 


“মায়ের ভয়-

শেষে ছেলেটা যেন বিগড়ে না যায়।”


সে সংগ্রাম তার কতটুকু সফল হতে পারবে?


অন্ধকারের ছায়ায় কবি দেখিয়েছেন প্রেম ও সাম্যের স্বপ্ন। যখন 


“ধর্ম ব্যবসা হয়ে উঠে

বেশ্যা সস্তা হয়ে উঠে

আমরা ক্রেতা হয়ে উঠি...।”


আর তাই


“পৃথিবীর কোন মানুষকে কেন জানি

সুস্থ বলে মনে হচ্ছে না…”


কবির।


“সবাই কেমন জানি অদ্ভূত!”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?