শিরোনাম - মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান

শিরোনাম - মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান

কবি শুভ্র সরখেলের ‘ক্রমাগত অন্ধকারে ডেস্কটপের ছায়া’ পুস্তিকাটি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। পড়লাম সেভাবেই। শেষ কবিতাটি পড়তে গিয়ে চোখ থেমে গেল “মাগো- ভাতের গন্ধে ঘুম আসে না!” আরও থমকে গেলাম শেষ স্তবকের “তোমার মাটির রঙ আস্তে আস্তে গা ছেড়ে দিচ্ছে!” শব্দ প্রয়োগে কবির মুন্সীয়ানা দেখে অবাক হতে হলো। পুনরায় সব ক’টি কবিতার শব্দের গভীরে যেতে ইচ্ছে হলো খুব। পুস্তিকার প্রথম কবিতা ‘বাল্যকালের বায়োস্কোপ’।


বায়োস্কোপের ভেতরে তাকিয়ে থাকা সেই চোখ দুটো’ স্মৃতির ভারে ছলছল হয়ে ওঠে আমার। হাত দিয়ে ঘুরিয়ে দেখা যায় এমন দুটো দন্ডের উপর ফিল্ম রোলের আদলে সযত্নে লাগানো থাকতো ইতিহাস, ঐতিহ্য, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি, নায়ক-নায়িকার পোস্টার। আমরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম পাওয়ারি কাচ লাগানো গোলাকার বৃত্তে। দুটি কানে প্রতিধ্বনি হতো প্রতিটি ছবির ইতিহাস, ঐতিহ্য, রূপ এবং কর্মের ছান্দিক সুর। খই ফুটতো যেন বায়োস্কোপঅলার মুখে।


‘বাল্যকালের বায়োস্কোপ’ কবিতায় কবি যাপিত জীবনের নানান চড়াই-উৎরাই বিভিন্ন উপমায় তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। একদিকে তিনি প্রবেশ করতে চেয়েছেন জীবনবোধের গভীর অতলে অন্যদিকে দৈনন্দিন পারিপার্শ্বিক টানাপোড়েন তাকে নিত্যনতুন ভাবনায় প্রবেশ করতে উৎসাহিত করেছে। ফলে কবিতার বায়োস্কোপে ভেসে ওঠা পোস্টারগুলোতে কবির ব্যক্তিকেন্দ্রীক চিন্তা- চেতনার প্রতিকৃতি যেমন মূর্ত হয়ে উঠেছে, তেমনই সাধারণ মানুষের বয়ে বেড়ানো নিত্য সমস্যাগুলো বহুমাত্রিক অবয়বে ফুটে উঠেছে। কবির বেড়ে ওঠার সময়টিকে তিনি বর্ণনা করেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে-


আমি বড় হয়ে উঠি বয়সের সাথে বেড়ে ওঠা

ভুলগুলো ছিঁড়ে। জন্মের পর শুনেছি পূর্বপুরুষের মহাভারত

মহাদেবের তান্ডবনৃত্য

ঘুরে এসেছি আমাজান হতে চিরহরিৎ বন।

এখনো শোনার বাকি আছে পলাশীর সর্বশেষ সত্য!

আমি বিজ্ঞ হয়ে উঠি সময়ের দেয়া

অভিজ্ঞতা বুঝে।


এতটুকুতে শেষ করলেও পূর্ণাঙ্গ কবিতার রূপই পেতো কবিতাটি। উদ্ধৃত সাতটি পংক্তির গভীরে প্রবেশ করলে কবির প্রত্যাশা, চিন্তার ব্রাপ্তি জ্বলজ্বলে ভেসে ওঠে বায়োস্কোপের ছবিগুলোর মতো। ছবিগুলোর বর্ণনা হতো শুধু একেকজনের কাছে ভিন্নতর।

মোঃ আতিকুর রহমান এবং সালমা জোহরা রচিত ‘মানববুদ্ধি, আচরণ ও সামাজিক পরিবেশ’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে-


“মানবজীবনের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো পরিবর্তন। স্থবিরতা মানুষের সহজাত প্রকৃতি বিরোধী।”


তাদের মতে-


  • প্রথমত- বিকাশের প্রতিটি পর্যায়ে কতগুলো সামজিক প্রত্যাশা থাকে।
  • দ্বিতীয়ত- বিকাশের প্রতিটি ক্ষেত্র ও পর্যায়ে বিপত্তির আশংকা বিদ্যমান।
  • তৃতীয়ত- বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে সুখের অনুভূতি বিভিন্ন হয়।


মানুষ মূলত প্রত্যাশা, আশঙ্কা এবং অনুভূতির অনুসঙ্গে মিলে মিশে জীবন গঠনে সক্রিয় থাকে। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। জীবন ঘনিষ্ঠ হিসাবের লেনদেন মেটাতে গিয়ে স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে কারও কারও। জীবনের সময়গুলো থেমে থাকে না কারুর জন্য। জীবন ক্ষণস্থায়ী অথবা দীর্ঘস্থীয়ী যা-ই হোক- জীবন পরিক্রমায় মানুষকে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করতে হয়। জীবনচক্রের প্রতিটি ধাপেই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং মাত্রা। কারও জীবনে যখন প্রতিকূল বিশ্বাস, মনোভাব বিরোধী এবং অবাঞ্ছিত আচরণ ধারা ক্রমাগতভাবে স্থায়ীরূপ লাভ করতে থাকে তখন সে হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। কেউ কেউ মেনে নেয় সময়ের যাতাকলে টাল সামলাতে না পেরে কেউ ভিন্ন মত অথবা পথ খুঁজে নিজের মতো করে ভেঙেচুড়ে গড়তে চায় সবকিছু, কখনো কবিতার আশ্রয় নিয়ে শুভ্র সরখেলের মতো বলে ওঠে কেউ, 


আমি বড় হয়ে উঠি বয়সের সাথে বেড়ে ওঠা ভুলগুলো ছিঁড়ে।


এর পর কবি বলেন,


চিলমারী থেকে জয়পুরহাট শেষে কাহালু

মাঝে মধ্যে বড় মামার সরকারি কোয়ার্টার।

মায়ের ভয়, শেষে ছেলেটা যেন বিগড়ে না যায়।

শেষাবধি বাদ পড়া জীবনের মাটি-মাখা সময়।

আমার মানুষ হবার দীর্ঘপথ জমা রেখে দেই

বসুন্ধরার কোলে। শেষমেশ মানুষ হবার পুনঃপ্রচেষ্টা।

আমি ঘুমথেকে জেগে উঠি কাল মার্কসের

অঙ্কগুলো কষে। কিছু ক্ষমা এসে জমা আছে

আমাকে শাস্তি দেবার জন্য। জীবনের ক্ষনিকটা সময় এখনো

পড়ে আছে অপেক্ষায়। পেয়েছি নতুনভাবে

হারিয়ে যাবার আতঙ্ক। আমি শান্ত হয়ে উঠি প্রকৃতির দেয়া

রঙধনু চিনে।


জীবন যাচে অনেককিছু। প্রত্যাশা সীমাহীন। সময় শুধু অনুকূলে থাকে না সবার। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বাঁধ সাধে স্বকীয়তা প্রকাশে। রাজনৈতিক টানাপোড়েন, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। জীবনকে একান্ত নিজের মত পরিচালনা করার উপাদানসমূহ অপ্রত্যাশিত কোন ঘুর্ণায়মান বলয়ে ঘুরপাক খায় প্রতিনিয়ত। তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না বিক্ষুব্ধ মনের। দূরত্ব ছেড়ে অধিক দূরত্বের পথ হেঁটে আসা হতাশ প্রাণের স্থবিরতা দেখে মায়ের অজানা আশংকা কবির মনে রেখাপাত করে। অতঃপর হতাশার ঘোর কাটিয়ে নিজের সাথে সমাজ পরিবর্তনের অঙ্গীকার জেগে ওঠে মনে। কাল মার্কসের চেতনায় আঘাত করে কবির। কিন্তু সাধ্য কোথায় সমাজ নামক শৃঙ্খলিত কারাগারের লৌহকপাট ভেঙে ফেলবার? সমাজের মানুষগুলোর একেকজনের ভিন্ন রঙ দেখে হতাশা ভর করে কবিমনে। নিজের অক্ষমতাকে ক্ষমা করতে ইচ্ছে করে না, তবু থেমে যেতে হয়, হারিয়ে যাবার আতঙ্ক ভর করে প্রাণে। অবশেষে শান্ত হয়ে ওঠা- এটাই যেন নিয়ম! কবি নিজেকে সান্তনা দিতে চান, শান্ত হয়ে উঠতে চান প্রকৃতির দেয়া রঙধনু চিনে। দ্বিতীয় স্তবকে তাই কবি লিখেন-


আশীর্বাদ নয়

শুধু মৃত্যুটা হোক শব্দহীন, চুপচাপ।

আমি রাত্রির কাছে হেরে গেছি, ভীষণ

আঘাত হানে গত সকালের সূর্যটা

ভেঙচি কাটে সমস্ত বিকেলের গাছতলায়

ছায়াভরা বিছানায় বসে থাকা সেই

দুজনের প্রেম!

পৃথিবীর সমস্ত চাঞ্চল্য আমার বন্ধু ছিল একদিন।

আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠি ভাগ্যের কর্মশালা দেখে।


কবি তার ভাগ্যের কর্মশালা পাঠ করেন অন্তর্দৃষ্টে, সেখানে বহুরূপী পৃথিবীর সব চাঞ্চল্যরা থেমে গেছে শয়ন কক্ষের বিছানা থেকে। গতকালের আলোক লুকানো সূর্যটা আঘাত হানে আশাহত বুকে। বিকেলের প্রশান্তিময় বাতাসও ভেঙচি কাটে যেন! নিস্তব্ধ রাতের কাছেও প্রত্যাশা নেই আর এতটুকু প্রশান্তির! পৃথিবীটা ঘুমায় নিঃশব্দে কবির বুকের গভীর থেকে ধুম্র’র সাথে বেড়িয়ে আসে হৃদয় পোড়া ঝাঁঝালো গন্ধ। অর্থহীন জীবন বয়ে বেড়ানো আর কতকাল! পৃথিবীটা আমার নয়, এখানে বেঁচে থাকা ভার। এমন জীবনে শুভাশীষের প্রয়োজন নেই- নয় কোন আশীর্বাদ। অপ্রত্যাশিত অথচ প্রতিটি জীবনের অমোঘ কঠিন যে সত্য, সেই মৃত্যু চাই। কবির মিনতি- কোন কোলাহল নয়, একাকী মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিতে দাও আমায়- শব্দহীন, চুপচাপ! তাই শেষাংশে কবি লিখেন-


জুলিয়াস সিজারের নোটবুকে লেখা ছিল,

ভগবানের কোন বিবেক নেই।

আর আমরাতো নেহাতই সাধারণ বান্দা;

তাই কখনো অভিশাপ দিও না

এই বলে, বাবা অনেক বড় হও।


কবিতার গাঁথুনিতে কবির মুন্সীয়ানার কথা আগেই বলেছি। তবে, শেষাংশের তৃতীয় লাইনে ‘বান্দা’ শব্দটির ব্যবহার দৃষ্টিকটু লেগেছে। এক্ষেত্রে ‘মানুষ’ শব্দটির ব্যবহার সঠিক হতো, যদিও গতানুগতিক। কবির উল্লিখিত জুলিয়াস সিজারের নোটবুকে আক্ষেপ করে যে লেখাটুকু ছিলো- সেটি ভগবানের সমীপে। জুলিয়াস সিজার একজন শক্তিশালী সেনাপতি ছিলেন সত্যি, তাই বলে ভগবানের কাছে বিশেষ ব্যক্তিগণেরও নেহায়েৎ বান্দা ছাড়া আর কোন পরিচয় দৃষ্ট হয় না, কোন ধর্মগ্রন্থে।


যাক সেকথা- কতটা অভিমান আর কষ্ট বুকে ধরে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী জুলিয়াস সিজারের আক্ষেপটি উল্লেখ করেছেন কবি সেকথা ভাবতে গেলে বুঝা যায় জীবন কতটা বিষময়। প্রখ্যাত রোমান সেনাপতি জুলিয়াস সিজার শক্তি, সাহস আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বিশাল রোমান প্রজাতন্ত্র, যার ঘোষণা ছিলো- এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। এতোটা সাফল্য আর শক্তির অধিকারী হয়েও তাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিলো! তিনি জয় করতে পারেননি বিশ্বাসঘাতকদের মন। কবি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। একজন সাধারণ মানুষের দম কতক্ষণ! সে কারণেই কবি কবিতার শেষাংশে এসে শুভশীস এবং জীবনের পূর্ণতা প্রত্যাশী পরিজনের কাছে মিনতি করেন- “বাবা অনেক বড় হও”, এ কথা বলে অভিশাপ দিও না আমায়।


বইটির ভূমিকায় ‘বাল্যকালের বায়োস্কোপ’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি উল্লেখ করে কবি লিখেছেন-


“প্রত্যেক মানুষের একটি জায়গায় পৌঁছতে কয়েকটি স্তর পেরিয়ে আসতে হয়। আমার এই সামান্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু অন্ধকার সময়ের বড় অবদান আছে।”


কবিতাটি আলোচনা শেষে আমার জীবনেও তেমন একটি অন্ধকার সময়ের অবদানের খুব প্রয়োজন ছিলো বোধ করি এবং অন্যদেরও, যারা লিখিয়ে। তাহলে হয়তো জীবনের চড়াই-উৎরাই, চিন্তা-চেতনা, মুখের আংশিক স্মৃতি, হারানোর হৃদয়গ্রাহী করুণ সময় ইত্যাদির সবকিছু মিলে ‘বাল্যকালের বায়োস্কোপ’ এর মত আরও অনেক পূর্ণাঙ্গ কবিতার জন্ম হতো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?