তপন কুমার রুদ্রে’র কবিতাগ্রন্থ ‘জলের বুকটাও দেখে ফেলেছি’ | সোলায়মান বাবুল

তপন কুমার রুদ্রে’র কবিতাগ্রন্থ ‘জলের বুকটাও দেখে ফেলেছি’ | সোলায়মান বাবুল

নিজেকেই সর্বত্র খুঁজে ফেরে মানুষ; তার ছুটে চলা যতগুলো পদচিহ্ন রাখতে পারে, তার নাগাল যতটা পরিলক্ষ্যকে ছুঁতে পারে, তার মনন যতটা স্বপ্নকে, যতটা কল্পনাকে ধরতে পারে। এই ক্ষেত্রগুলোতে মানুষ ছুটছে বিরামহীন। যাপিত জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনগুলো ছুটতে বাধ্য করছে মানুষকে। জীবনে টিকে থাকবার, জীবনকে অদৃশ্য এক উচ্চতায় নিতে সিঁড়ি ভাঙ্গবার, যাপন যাপন খেলাটার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়বার একটি মনোজ্ঞ ক্রীড়ানুষ্ঠানে সারাক্ষণ ব্যস্ত মানুষগুলো। সময় কোথায় মানুষের; তার মানবিক সত্ত্বার পরিচর্যার কথা ভাববে এতটুকুন !

অল্পকিছু মানুষ আছেই, এত এত মানুষের মাঝে ব্যতিক্রম। তারা জীবনের কাছেই জীবনকে গচ্ছিত রাখে আর প্রতিশ্রুতি দেয় মানবিক সৌন্দর্য পরিপালনের। জীবন তাদের ফেরায় না, আগলে রাখে পরম যত্নে। অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক কোন অভাব তাদের কক্ষনই পরাস্ত করতে পারেনা। অভাবগুলো তাদের কাছে এসে ব্যর্থ হয় বারবার। একটা নিজস্ব পরিমণ্ডল, নিজস্ব আলো বাতাস, নিজেতেই নিজের অসীম হয়ে উঠাতে বুঁদ হয়ে থাকে তারা। আমরা সবাই একত্র, কিন্তু, এই মানুষগুলোকে অন্যেরা খুঁজে পায়না। নিজের সুন্দরকে নিয়ে এই মানুষেরা সমাজভোলা! মানুষের সুখ-দুঃখ, মানুষের পাওয়া-না পাওয়া, সীমা-পরিসীমা, ধর্ম-অধর্ম ইত্যাদিকে নিজেতে ধারণ করে এরা আর এসব নিয়ে কাজ করে তারা, এ কাজগুলোই তাদের মুখ্য কাজ । বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সাহিত্যিক ... এঁরা এইসব মানুষ !

তপন কুমার রুদ্র তাদেরই একজন, একজন সাহিত্যিক। পেশায়  ইংরেজি বিষয়ের অধ্যাপক। মননে একজন কবি, একজন প্রবন্ধকার, একজন গল্পকার, একজন ঔপন্যাসিক। তার কাব্যগ্রন্থ , “জলের বুকটাও দেখে ফেলেছি”। ত্রিশটি কবিতা নিয়ে কাব্যগ্রন্থটি ।

গ্রন্থটির একটি কবিতা, ‘আজ আমি কবি’। এখানে কবি বর্তমান মানব সভ্যতার অতিমানব হয়ে উঠবার যাবতীয় আচরণকে নির্দ্বিধায় অগ্রাহ্য করছেন। মানুষের বাহ্যিক চেহারাটাকে মোটেও আমলে না নেবার উচ্চারণ তার কণ্ঠে। ভেতরের পরিশুদ্ধতার কথা বলছেন তিনি:

এতদিন বলি নাই
বলতেও শুনি নাই নিজেকে
আজ বলি- আমি একজন কবি
নিকৃষ্ট কি উৎকৃষ্ট
তা-ত জানি না।...  

ইংরেজি সাহিত্যের গুণী অধ্যাপক, বিভাগীয় প্রধান। সভ্যতার এই সামাজিক পদ-পদবীতে এতটুকু মোহ নেই তার, এ শুধু জীবিকার প্রয়োজন। জীবিকাতেই তিনি সে পরিচয় ফেলে রাখলেন। তার ভিতরের সুন্দরেই তার যত মোহ! কবি তিনি, এতেই তার সবটুকুকে খুঁজে পান তিনি ।

প্রেমই যদি জীবনে না থাকবে, সে জীবনকে নিয়ে আহামরি বেঁচে থাকাতে প্রয়োজনটা কী? সেতো জোর করে দেখিয়ে বেড়ান যে, আমি বেঁচে আছি ... বেঁচে আছি! পরানের গহীনেতো তার শুধুই শূন্যতা, শুধুই অন্ধ চোখ। বর্তমান সভ্যতা যেমনটা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে তার ঘরদোর, ধরা দিচ্ছে কী আলো তাতে? দিচ্ছে না। তাই, আলোর উৎসের ঠিকানা দিচ্ছেন কবি তার ‘আলো তুমি নিভে গেলেও’ কবিতায়: 

আলোটা নিভে গেলে
আরো বেশি আলোকিত হয়ে উঠে এই ঘর
পেখম গোটান ভুরু, আর চোখে জাগে
অমৃত সাগর, কালের মক্ষিকা  হয়ে;
চোখদুটো তীর হয়ে সাঁইসাঁই শব্দ তুলে
বিঁধে হৃদয়ের পরান গহীনে ... !

সভ্যতার শ্রেণী বৈষম্য যে পৃথিবীটাকে কতটা ক্ষুধার্ত করে তুলেছে, কতটা বিষাক্ত করে তুলেছে, কতটা লক্ষ্যহীন করে তুলেছে সে কথা বলছেন কবি। শোষন, বঞ্চনা আর অত্যাচারের পৃথিবীটা মানুষকে তার শৈশব থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। শোষিত মানুষ সারা জীবনে শত সংগ্রাম শত যুদ্ধেও সেখান থেকে বের হতে পারছে না! কবি তার কবিতা, ‘মদির আঁধার ছুঁয়ে’ তে বলছেন:

ক্ষুধাময় পৃথিবীর বুক চিনেছিলাম
অরণ্য শৈশবের দিনে
আকুলিত সরীসৃপ- ক্ষুধা বেঁকে বসে আজো
স্থাপিত আঁধারে, এমনকি আয়ত চোখ দিয়ে দেখা
সজল দিনের ফর্সালোকে বড়বেশি অতৃপ্ত আলোর কণিকায় ... !

স্রষ্টাতে প্রণত কবি। সৃষ্টিতে যার মহৎ মহিমা তাকে এড়িয়ে যাবার দুঃসাহস দেখাচ্ছে সভ্যতা। এ দুঃসাহস যে তার ধ্বংস ডেকে আনবে, এমন পরিণামটা বিস্মৃত না হয়ে স্রষ্টাতে অনুগত থাকবার সদুপোদেশ দিচ্ছেন কবি। সকলকিছুর শেষে মানুষকে যে  ধর্মের কাছেই, স্রষ্টার কাছেই ফিরে আসতে হবে সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কবি তার কবিতায় বলছেন:

শত দোষে শত হঠকারিতায় শত দায়িত্ব অবহেলায়
পেয়েছি ক্ষমাদর্পী অকৃপণ দান ভালোবাসা ... !

কবির অন্যান্য কবিতাগুলোতেও তিনি বিষয়ে, বলায়, কাব্যসৃষ্টিতে তার কবি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কবিতাগুলোতে মুক্ত ছন্দের আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। তিনি যা বলতে চেয়েছেন, কবিতাগুলো তা গ্রহণ করেছে নির্দ্বিধায়। তপন কুমার রুদ্রের কবিতাগুলোতে তার নিজের একটি কাব্য ঘরানা প্রচেষ্টা আছে, কবি এখানে সফল হয়েছেন বলা যায়। মেঠোজন প্রকাশনা, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘জলের বুকটাও দেখে ফেলেছি' কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলো সবার ভালো লাগবার মত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?