কবি তপন কুমার রুদ্রের লেখা কবিতার অণুগ্রন্থ ''মাকে বলা আমার কিছু মিথ্যে কথা এবং...'' নিয়ে কিছু কথা | জাহানুর রহমান খোকন

কবি তপন কুমার রুদ্রের লেখা কবিতার অণুগ্রন্থ ''মাকে বলা আমার কিছু মিথ্যে কথা এবং...'' নিয়ে কিছু কথা | জাহানুর রহমান খোকন

নদ-নদীময় মফস্বল শহর কুড়িগ্রামে বেড়ে ওঠা একজন টগবগে ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলের রাজনৈতিক ভাবনাবোধ ও গ্রাম্যজীবন সংগ্রামে টিকে থাকা, ১৯৪৭ সালের পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মায়ের স্নেহাশীষ ধন্য পুত্রের জীবন থেকে নেওয়া কথামালার ভাব সংকলন এই কবিতা গ্রন্থটি। লেখকের ভাষায়,
'অনেক ভাবের ছোট রূপ কবিতা।'
কবির হাতে লেখা পান্ডুলিপির একটি কবিতা সমেত পাতা ছিড়ে লাল জমিনের মাঝে সাদা পাতায় গোটাগোটা কালো হরফে লেখা কবিতা বসিয়ে সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন আবিদ হোসেন। গ্রন্থটিতে মোট কবিতা রয়েছে মাত্র ১৩ টি। যার প্রথম কবিতাটির নাম 'মাকে বলা মিথ্যে কথা'। কবিতাটিতে কবি ১৯৬৯ সালে যখন স্বাধীনতার ডাকে দেশ উত্তাল তখন মাকে বলেছে সে ক্যাম্পাসে গিয়ে আর কোন মিছিল, মিটিং এ যাবে না। কিন্তু ক্যাম্পাসে গিয়ে কবি ছায়া ঘেরা শীতল ক্যাম্পাসের মধ্যে যেখানে দাঁড়িয়ে প্রফেসর জোহা নিরব চাদরে মুখ ঢেকে ঈঙ্গিত দিচ্ছে বিজয়ের মিছিলে অংশ নিতে। সেখানে গিয়ে মায়ের কথা ভুলে যায়। যে মা গ্রাম থেকে কষ্ট করে টাকা পাঠায় সেই মায়ের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভুলে রাজপথের আগুন ঝলসানো মিছিলে যুক্ত হয়। মায়ের কথা ভেবে নিজে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়- মা তো রয়েছে দূরে, জানবেনা আমি আবারো গিয়েছি মিছিলে।

'শত মিথ্যে বলেছি মাকে যদিও
পাপের বাপের কী সাধ্য বলে,
নষ্ট হয়েছি, কষ্ট দিয়েছি মাকে।'

কবিতা গ্রন্থটির দ্বিতীয় কবিতার নাম 'ধরা পরেছিল মিথ্যে।' সেখানে কবি সুন্দরভাবে স্বাধীনতাপূর্ব বাংলায় নতুন পতাকা ও দেশ গড়ার মিছিল যখন সারা দেশ উত্তাল তখন মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, মাত্রতো কয়েকটা দিন, দেশ শান্ত হবে আবার। মুজিব-ইয়াহিয়া বসবে আলোচনায়। বাঙ্গালীরা পাবে ক্ষমতা। কিন্তু সময় চলে যায়। ২৫ শে মার্চ রাত পেরিয়ে ভোর হয়। পাকিস্তানিদের জবাব দিতে বাঙ্গালীরা জোট বাধে আর রাজনীতিঘেঁষা ছেলের গ্রাম্যজননী সরলতা নিয়ে বলে, 'আসল যুদ্ধ হবে তো এবার। কেন মিথ্যে সান্ত্বনা দিস আমায়!'

'যে বাতি নিভেনা কোনদিন' কবিতায় কবি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় সাম্প্রদায়িক হামলার বর্ণনা ও দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয়ের চিত্রায়ণ করেছেন। সেখানে শরণার্থী শিবিরগুলোতে কিভাবে দিন রাত বাঙ্গালীদের দেশের জন্য স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও বাসনার কথা হতো তার বর্ণনা দিয়েছেন। এরকম একদিন সকালে কবির মা ও তার কাকিমারা আলোচনা করছিল দেশ স্বাধীন হলে কি দেশে ফিরে যাবে নাকী এদেশেই থেকে যাবে। এমন সময় টেলিগ্রাম হাতে ছুটে আসে হকার, নেবেন নাকী এক কপি। স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ হবে সেই প্রত্যাশা নিয়ে লেখক মায়ের কাছে আকুতি জানায় স্বদেশে এবার হিংসা বিদ্বেষ পাবেনাকো ঠাঁই। সকলে পাবে সমান অধিকার। আর তাইতো তিনি তার 'অনার্য শুদ্রদেব' কবিতায় বর্ণনা করেছেন যাজক বলে গেছেন, শুদ্রদের এদেশের কোন সম্পত্তিতে অধিকার নাই। অথচ এই অনার্যরাও ৭১ সালের যুদ্ধে কদর্যবীরের ভোগ্যবাহু থেকে বধ্যভূমিকে রাহুমুক্ত করেছেন। কবি তার জননীকে বললেন, 'দেশে চলো এবার। শেখ মুজিবের সোনার বাংলায় সকলে পাবে সমান অধিকার। তাদের জীর্ণশীর্ণ দেহ, হাড্ডিসার পাঁজরেরা রক্তপুষ্ট হবে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে শুভ্রদের দখলে শুদ্ররা শুধুমাত্র অনার্য হবার দায়ে অহর্নিশ ভূগছে। কবি তার কবিতার ভাষায় দায়মুক্তির শ্বাস ফেলেছেন এভাবে-

'আজ বড় বাঁচা, বেঁচে গেছি
মা বেঁচে নেই তাই,
নাহলে সেই প্রশ্নটি আবারো করতো
তুই এতো মিথ্যে কেন বলিস আমায়!'

এরকম হাজারো মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে কবি বিভিন্ন সময়ে মাকে স্বদেশের আগামী দিনে মঙ্গল বার্তার কথা শুনিয়েছেন। 'কলঙ্ক নতুন শতাব্দীতে' কবিতায় কবি মাকে প্রতিজ্ঞা করে বলেছেন, সালটা '৭১। মুজিব যখন ক্ষমতায় তখন কেউ ঠকবেনা এবার। কিন্তু বছর পাঁচেক যেতেই নিজের দেশের মাটিতে নিজের মানুষের হাতে খুন হলেন বঙ্গবন্ধু। কবি এটাকে বলেছেন কলঙ্ক নতুন শতাব্দীতে। আর তিনি এবার মাকে নয় নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন,
'ভাগ্যিস মা চিরনিদ্রায় গেছেন আগেই। নাহলে আমার মিথ্যে উন্মোচিত হতো এবার।'

উপরিউক্ত কবিতালোচনা থেকে আপনারা মনে করতে পারেন কবিতা গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা। কিন্তু সেটি নয়। কারণ কবি এই অণু কবিতা গ্রন্থে সমকালীন কিছু বিষয় নিয়েও লিখেছেন। যেমন ২০০৭ সালের সিডর নিয়েও তার একটি কবিতা রয়েছে। 'সিডর আক্রমণে' কবিতায় সে সময়ের মানুষের বাঁচবার যে আকুতি, জীবনের প্রতি যে মায়া তার চিত্রায়ণ ফুটে তুলেছেন। আবার প্রতিটি লেখক বা কবি তার গল্প, কবিতা কিংবা উপন্যাসে নিজের অগোচরে তার নিজ মাতৃভূমির কোন না কোন একটি বিষয়ের স্বাক্ষর রেখে যান। কবি তপন কুমার রুদ্র তার ব্যতিক্রম নন। তিনি তার আপন কাকাতো ভাইয়ের পানিতে ডুবে মৃত্যুর বর্ণনা দিয়েছেন 'যাবো না আমি ঐ নদীটার কাছে' কবিতার মাধ্যমে কুড়িগ্রামের নদ-নদীতে বন্যার তীব্রতা ফুটিয়ে তুলেছেন।

মৃত্যু ভয় প্রত্যেকের ভিতরে একসময় বাসা বাধে। কবি তার শেষ কবিতাটিতে মৃত্যু নিয়ে তার স্বাভাবিক প্রস্তুতির কথা ব্যক্ত করেছেন। মৃত্যু যে তার মনোজাগতিক চিন্তায় প্রভাব বিস্তার করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার পরকাল ভাবনা নিয়ে লেখা কবিতা 'দেখেনি কেউ, শুনেছে সবাই' কবিতায়। তিনি তার কবিতায় ইহজাগতিক চিন্তা ছেড়ে পরপারের অদেখা জগতের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।

কবি তার কবিতায় বলেছেন-

'জানি আমি জানি, আজ বেশী করেই জানি
যাবো, যাবো, যাবো, আমি যাবো-
তোমাদের মতন ঠিক তোমাদের মতন
লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, যেতে সেই দেশটাতে।'

কিন্তু কবি নিজেই আবার সুন্দর এই পৃথিবীর মায়ায় জড়িয়ে গিয়ে লিখেছেন, 'যে দেশটা কেউ দেখে নি, সেই বোবা দেশটা চাই ভুলতে।' এছাড়াও অণু কবিতা গ্রন্থটিতে 'কে তুমি', 'বড় প্রত্যাখ্যান', 'খাওয়াটা তার হয় না ভাল', 'এবার ভাঙ্গ সিন্ডিকেট' নামের মোট ১৩ টি কবিতা রয়েছে। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এবং মাটি ও মানুষ থেকে মুদ্রিত কাব্য গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩০ এবং বইটির মুদ্রিত মূল্য ৫০ টাকা। প্রকাশকাল- ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?