কবিতায় শ্রেণীঘাতঃ কবিকে কবি হতে বলা | মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান

কবিতায় শ্রেণীঘাতঃ কবিকে কবি হতে বলা | মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান


যদি কবি হও
যদি বাঁচাবার ও বাঁচাবার পথটাতে
পথরেখা কলি ফোঁটাবার সাধে
হতে চাও বড় কথামালাকার সজ্জন
তবে বিষয় বিভ্রাটে তুমি পরবে না।

"কবিতায় শ্রেণীঘাত" কবিতার শুরুটা এভাবেই করেছেন কবি তপন কুমার রুদ্র। উদ্ধৃত অংশটুকুতে তিনি একজন শিক্ষকের মতো জানিয়ে দেন যে- তুমি যদি বড় কথা মালাকার হতে চাও তবে তোমার প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে কলি ফোটাবার সাধনা। তোমার সৃষ্ট পথ যদি ফুলেল এবং মসৃণ হয় তবে তুমি অনায়াসে এঁকে যেতে পারবে দিগন্তরেখা, তুমি বিষয় বিভ্রাটে পড়বে না কখনো। এরপর-

যদি টুপটুপ বারিপাতে দিনপাত অসহিষ্ণু হয়
হয়তো বসবে লিখতে কবিতা
ভাবনার জাল বোনা হলে শেষ
বিষয় বিভ্রাট উঠে আসবে

দৈনন্দিন জীবনে অসহিষ্ণুতাই সহজলভ্য। হৃদয়ঘটিত রক্তক্ষরণ, অব্যক্ত উচ্চারণগুলো কবিতার ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে দিতে একজন কবি যখন লিখতে বসেন নতুন কোন কবিতা, একা একা ভাবনার জাল বুনে যান, অসহিষ্ণু সময়ের ভাবনাগুলোকে একেকটি নতুন রঙের প্রলেপে সৃষ্টি করেন নতুন রঙের রঙিন সুতোয় ঠিক তখনি নেমে আসে নতুন কোন বিভ্রান্তি উঠে আসে নতুন কোন বিভ্রাট।

হয়তো বিরস চোখে অর্থহীন ঝিলিমিলি ভাসবে
প্রেমকথা ভাবব্যথা প্রণয়ীর মুখ
পাপ পূণ্যের বিচার শেষে নিসর্গের রহস্য কথন
তোমারে কাঁপাবে হয়ত জলভেজা গোলাপের মত
সেখানেই চরম তৃপ্তি যদি নেশাতুর না করে তোমায়
মদালসা গানে
আর যদি এ যাবৎকালের
প্রেম কিংবা রহস্য প্রেমের তাবৎ কাব্যগণ্ডী আলোকিত করে
যত অসার কল্পনা ও মডেল কন্যার মতো বাকপ্রতিমা তোমার
তবে উর্ধ্বে তুলে চোখ

বিভ্রান্ত কবিকে তিনি বলছেন- বিরস চোখে অর্থহীন ঝিলিমিলি, প্রেমকথা, ভাবব্যাথা, প্রণয়ীর মুখ, নিসর্গের রহস্য কথন যদি জলভেজা গোলাপের মত আচ্ছন্ন করে তোমায়। প্রেম কিংবা রহস্য প্রেমের কাব্যগণ্ডী পেরুতে নিজেকে আলোকিত ভেবে মদালসা গানে চুর হয়ে যাও তবে বিভ্রান্তিতে পরবে আবার। প্রণয়াসক্তির পথ ছেড়ে অন্তর্দৃষ্টিতে প্রখরতা আনতে হবে আবার "উর্ধ্বে তুলে চোখ"

ভাবো অন্যকথা
শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়ায় লিপ্ত কর আর একটি নিঃশ্বাস
-“পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস"
চরম অনিবার্য যার ব্যপ্ত প্রতিফলন
যুগে যুগে সর্ববুকে-সর্বক্ষেত্রে-চরাচরে-লোকাচারে
এমন কি অনাচার ব্যভিচারসহ ইতিহাস দর্শনে;
রিক্সাওয়ালার সাথে যাত্রীর সম্পর্কে
পিয়ন বেয়ারার সাথে অফিসের কর্তার সম্পর্কে
কৃষিকর্মী মজুরের সাথে জোত-মহাজনের সম্পর্কে
উৎপাদন কর্মীর সাথে উৎপাদনী ব্যবস্থাওয়ালার সম্পর্কে
লঘু গুরু সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে বিষেদঘারের সম্পর্কে
দলবাজ নেতার সঙ্গে বুদ্ধিভ্রষ্ট কর্মীর সম্পর্কে
এবং
মনুষ্য সমাজের গর্ভে জন্ম নেয় অজস্র কাতারে
সহস্র বন্ধনীযুক্ত সকল সম্পর্কে
একটি অমোঘ প্রথা কথা কয়ে যায়
-পৃথিবীর ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস
এর ব্যাপ্তি খোঁজার পথে

উপর্যুক্ত চরণগুলিতে তিনি জানিয়ে দিলেন- কবির ভাবনার সীমা কোথা অবধি পৌঁছুতে পারে। প্রেম, কাম, মদালসা গানের নেশা জয় করে কবিকে এগিয়ে যেতে হবে মানবধর্ম প্রতিষ্ঠায়। কবিকে লিখতে হবে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস- তার অনিবার্যতা এবং প্রতিফলনের প্রক্রিয়া। মানব এবং প্রকৃতির আচার, অনাচার, ব্যভিচার এর কোনটি গ্রহণযোগ্য, কোনটি পরিত্যজ্য। মানুষের সাথে মানুষ, মজুরের সাথে মালিক, লঘু সম্প্রদায়ের সাথে গুরু সম্প্রদায়; কেমন হওয়া উচিত পারস্পরিক আচরণ। কোন সব আচরণে ধ্বংস হয়ে যায় জাতি, প্রকৃতি এমনি সব নিগুঢ় চিন্তার বাস্তব রূপ। কবিতায় তুলে ধরতে তিনি কবিকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে বলেছেন তার দৃষ্টি তথা চোখকে। ইতিহাসের ব্যাপ্তি খোঁজার পথে যাত্রার আহ্বান জানিয়ে কবি বলেন-

কবি তব যাত্রা যদি কর নিরুদ্দেশ
তোমার উদ্দেশ পাবে দিনান্তের সবটুকু ছায়া
আহরিত উদ্বেগ সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে
বিবেক দংশন থেকে পাবে সে নিস্তার।

কবিতাটির এই চারটি লাইন তিনি জানিয়ে দেন তার নির্দেশিত পথই কবির বিভ্রান্তি অবসানের পথ। ইচ্ছাতেই হোক কিংবা অনিচ্ছাতে মানুষ যে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ সেকথা অকপটে স্বীকার করেছেন তিনি। দায়বদ্ধতার শৃংখলে আবদ্ধ প্রতিটি মানুষ কখনও ভুলে যাবার ভান করে এড়িয়ে যেতে চাইলেও দায়বদ্ধতা তার পিছু ছাড়ে না। কখনও না কখনও এই দায়বদ্ধতা তাকে পীড়া দেয় আর তখন মানুষ তার দায়বদ্ধতার আত্মনিপীড়ন থেকে মুক্ত হতে চায়।

কবিকে হতে হয় নিরুদ্দেশের যাত্রী। নিরুদ্দেশের পথে চলতে চলতে একমাত্র কবিই পারে নতুন পথের সন্ধান বের করে আনতে। মানুষকে জীবনের পথ দেখাতে।

কবিতাটির শেষাংশে তিনি বলেছেন-

সত্যভাষী কবি হবে তুমি
হবে সুন্দর ক্ষণের স্রষ্টা
নিঃশেষিত প্রাণে গড়া বৃত্তান্ত অনিঃশেষ
যদি কবি তুমি আঁক সেই বৃত্তান্তেরই ছবি
তবে যাত্রা তোমারও হবে অনিঃশেষ
অনির্বাণ বৈচিত্র্য হবে তোমার সৃষ্টির শরীর

এতটুকু বলার পরে নতুন করে কিছু বলার অবকাশ থাকে না আর। কবি যদি সত্যভাষী হন; সুন্দর ক্ষণের স্রষ্টা হন, নিঃশেষিত প্রাণে অনিঃশেষ বৃত্তান্ত গড়ার কারিগর হন তবে তার কবিতা কিংবা সৃষ্টি হয়ে ওঠে চির অনির্বাণ শিখা। হয়তো কেউ-কেউ কখনো কখনো কিংবা কারও-কারও দোসররা কবি'র সৃষ্ট বিষয় নিয়ে শুধুমাত্র সমালোচনার প্রয়োজনেই সমালোচনা অথবা অযথা দাঁড় করাতে চাইবে হিংসার কাঠগড়ায়। কি আসে যায় তাতে, পৃথিবী তোমার মূল্যায়ন করবে। এমনি নির্ভরতার আশ্বাসবাণী শোনান কবি।

দোসর তোমাকে করবে বিষয় বিভ্রাট?
সে অসম্ভব! সে অসম্ভব!

সম্পূর্ণ কবিতাটি পাঠ করে একথা বলা যায় যে, সমাজের যতটুকু শ্রেণীবৈষম্য এখানে ফুটে উঠেছে তার চেয়ে অনেক বেশী নির্দেশনা এসেছে শ্রেণীহীন বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় একজন পথহারা অথবা বিভ্রান্তে বিভ্রাট কবি'কে পথ দেখিয়ে দেয়ার। চলতি সমান্তরাল পথে বিভ্রাট এলে ভিন্ন পথে মনোনিবেশ করে সত্যকে তুলে ধরার প্রয়াসে কবিকে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে কবিতার ছত্রে ছত্রে। মোদ্দা কথায় কবিকে কবিই থাকতে বলা- কবিকে কবি হতে বলা।

কবি তপন কুমার রুদ্র'র "কবিতায় শ্রেণীঘাত" কবিতাটি আলোচনা করতে গিয়ে বারবার চোখে ভেসে উঠছিলো সৌম্য, শান্ত, জ্ঞানভারে মাথা নুয়ে আসা এক সজ্জন ব্যক্তির মুখ। লম্বা লম্বা পা ফেলে সম্পূর্ণ নিজস্ব স্টাইল হেঁটে চলা ছিলো যার নিত্য অভ্যাস। যে মানুষটির পাশ দিয়ে যে কেউ তাকে এড়িয়ে যেতে পারেন অনায়াসে দেখতে পাননি ভেবে। তার প্রখর দৃষ্টি থেকে কিন্তু বাদ পড়তো না কিছুই।

সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক যে কোন আচার অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছিলো শিক্ষকের মতো। মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কোন বিষয়ের উপর আদ্যোপান্ত অনর্গল বলে যাওয়ার স্বভাবটা আমার কাছে এক চলন্ত সেলুলয়েড ফিল্ম বলে মনে হতো। একটা মানুষ কতটুকু জ্ঞানের গভীরে ডুব দিলে একজন তপন কুমার রুদ্র হয়- আজও সেকথা ভেবে অবাক হই আমি। তাঁর জ্ঞানের ব্যাপ্তির তুলনায় প্রকামিত প্রকাশনার সংখ্যা অতি নগণ্য। ইচ্ছাতে হোক অথবা অনিচ্ছাতেই হোক আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে একটি জ্ঞানবৃক্ষ। এ শূন্যতা কখনো পূর্ণ হবার নয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?