"অমীমাংসিত ফুলের দেবতা" কাব্যের আলোচনা - সুশান্ত বর্মণ

তীব্র কুড়িগ্রাম - অমীমাংসিত ফুলের দেবতা বইয়ের আলোচনা - সুশান্ত বর্মণ

এই সময়ের তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল কবি মাহফুজুর রহমান লিংকন। ২০২১ সালের বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর "অমীমাংসিত ফুলের দেবতা" নামের একটি কবিতাবই। প্রচ্ছদের মত কবিতাগুলোও পাঠককে প্রচলিত প্রেক্ষাপটের আড়ালে থাকা ভিন্নমাত্রার চেতনাপ্রবাহের অভিজ্ঞতা দেয়। পাঠক আলোড়িত হন, শিহরিত হন। নতুন চিন্তার প্রতিধ্বনি অনুভব করে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। কবিতাভাবনার প্রবাহে কবি মাহফুজুর রহমান লিংকনের কর্মশৈলী পাঠককে এক নতুন আবেগের অভিজ্ঞতা দেয়।


মোট সাতচল্লিশটি কবিতা নিয়ে তাঁর কাব্যগ্রন্থের আয়োজন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কবিতা পাঠককে নতুন ভাবনার প্রান্তে পৌঁছে দেবে; জানাবে কবির ভাবনাপদ্ধতির স্বকীয়তা। কবিতাকে যে তিনি প্রচলিত মাপকাঠিতে মূল্যায়ন করেন না কিংবা পুরনো অতীন্দ্রিয় বাণীর মত অনিবার্য ভাবেন না, তার পরিচয় রয়েছে কাব্যগ্রন্থের ছত্রে ছত্রে।


বিষয় নির্বাচনে তাঁর রুচি যেমন অভিনব, তেমনি উপস্থাপনেও তিনি বর্ণিল। শব্দ ব্যবহারে তাঁর চিন্তাশৈলী পাঠককে কবিতার লাইনে লাইনে আটকে ধরে রাখে। কবিতার বিষয় ভাবনা করতে গিয়ে কবি তাকিয়েছেন নিজের পরিপার্শ্বের দিকে। দেখেছেন অগণন মানুষকে। প্রকৃতির তুচ্ছাতিতুচ্ছ দৃশ্যাবলীও তার দৃষ্টি এড়ায় না। মানুষের আবেগকে প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করেন নিজস্ব বোধ মাখিয়ে। শব্দের প্রচলিত অর্থের আড়ালে ভিন্ন অর্থকে খোঁজেন। নতুন অর্থের নিরিখে অনুভব করার চেষ্টা করেন। আর তাই নিজের কাব্যগ্রন্থের নাম রাখেন "অমীমাংসিত ফুলের দেবতা"। শব্দের সাথে শব্দার্থের পারস্পরিক সম্পর্কের এই যে নতুন সংশ্লেষ তার পরিচয় গোটা কাব্যেই রয়েছে। 'বয়ান' কবিতায় তিনি বলেন-


    বিভাজিত

    নিষিদ্ধ জমিতে উঠবে না চাঁদ।

    চাঁদের বিরুদ্ধে

    মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে

    উড়ছে তিতির। পৃষ্ঠা- ১৯


‘গাছেরা সঙ্গম করেনা' -কবিতায় লক্ষ্য করি কবি এক ভিন্নমাত্রিক চিন্তাবলয়ে নিজের মৌলিক মগ্নতাকে উন্মোচন করেন।

    তোমার আমার মতোই গাছেদের সঙ্গম নেই।

    মুখস্থমৈথুনে জেগে উঠেছিলো

    বার্তা তাঁর। পৃষ্ঠা- ২৭


‘ভালো থেকো' কবিতায় লেখক অনায়াসসমগ্রতায় বর্ণনা করেন শব্দের ওপারের শব্দময়তাকে -


    পূর্ণিমার ঘোর কেটে গেলে

    শব্দ চুরি হতে হতে

    নদী স্পষ্ট জেনে যায়

    এবার কবিতা হবে। পৃষ্ঠা- ৩২


"আমাদের সুবর্ণসূর্য থেকে অদৃশ্য হয়েছে আলো" কবিতায় কবির অকপট স্বীকারোক্তি আমাদের সামনে এক অকথিত প্রেক্ষাপটকে উপস্থাপন করে-


    রাত ও নদী মিতালি গড়ে

    কফিনেই জন্ম দিয়েছিলে

    জন্মান্ধ সন্তান। পৃষ্ঠা- ৫৫



কবি তাঁর কবিতার নামকরণে অন্য মাত্রা আনতে চেয়েছেন। প্রচলিত পদ্ধতির নামের পাশাপাশি তিনি স্বকীয় বোধজাত ভিন্নরূপের শিরোনাম ব্যবহার করেছেন। যেমন একটি কবিতার নাম-


    অনেক তৃষ্ণা ভিতরে, আগুনের/ প্রেমের/ যন্ত্রণার/ কান্নার/ মরণের/ তোমাকে হারাবার/ সমুদ্রের/ শাদা-কালোর/ অভিমানের/ ভুল শোধরাবার/ এবং কবিতার/ অতঃপর কবিতার/ তবুও কবিতার…

    (পৃষ্ঠা- ৩৪)


এখানে কবি বারবার স্লাশ (/ ) ব্যবহার করে বিভিন্ন শব্দ এবং শব্দবন্ধকে আলাদা করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে শব্দগুলোর অর্থ আলাদা হলেও কবি প্রত্যেকটার মধ্যে সংশ্লিষ্ট কবিতার ব্যঞ্জনা পেয়েছেন। মনে করেছেন এরা আলাদা হলেও পরস্পর সন্নিহিত, আর তাই কোন শব্দকেই উপেক্ষা করতে পারেন নি। আপাতদৃষ্টিতে শব্দগুলো পরস্পর সম্পর্কবিযুক্ত মনে হলেও কবির চেষ্টা একটা ঐক্য খোঁজার। আর এই ঐক্য অন্বেষণ চেষ্টার বিবরণ পাওয়া যায় কবিতাটির মধ্যে। একই রকমের একাধিক শব্দ সজ্জিত নামকরণ রয়েছে আরও দুটি কবিতায়। সফলতম শব্দ খোঁজার এই যে প্রবণতা তা আসলে কবির পরিশ্রমী মনোভাবেরই পরিচায়ক।


তরুণ কবি তাঁর কাব্যে নতুন কাব্যভাষার আশ্রয় নিতে চেয়েছেন। কবিতার প্রথাগত অবয়বকে পাল্টে দিতে চেয়েছেন; প্রচলিত ফর্মকে ভেঙে দাঁড় করাতে চেয়েছেন এক নতুন কাঠামোবদ্ধতা। এর চিহ্ন কাব্যমধ্যে একাধিক কবিতায় দৃশ্যমান। শিল্প অন্বেষণে শৈলীর এই বিনির্মাণ তরুণ কবির ভবিষ্যৎ সফলতার হাতছানি দেয়।


মাহফুজুর রহমান লিংকন রচিত 'অমীমাংসিত ফুলের দেবতা' কাব্যে একই শিরোনামের অধীনে একাধিক কবিতা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'নিরীশ্বর কবি' এবং 'হাসপাতাল সিরিজ'। 'নিরীশ্বর কবি' শিরোনামে কবিতা রয়েছে পাঁচটি আর 'হাসপাতাল সিরিজ' শিরোনামে রয়েছে একুশটি। এই কবিতাগুলো সম্পর্কে ভূমিকায় দু'য়েকটা কথা থাকতে পারত। তাহলে কবিতাগুলোর প্রকৃতি সম্পর্কে পাঠকের হৃদয়ে বিভ্রান্তি থাকতো না।


প্রচ্ছদচিত্রে রাজীব দত্ত বরাবরের মতো নিজের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। শক্ত মোটা বোর্ড বাঁধাই কভারের বইটি ছোট আকারের। ১৩×১৮.৫ সে.মি. আকারের বইটি সহজে বহন করা যাবে। অর্থাৎ পাঠক ভ্রমণরত অবস্থায় পকেটে বা ব্যাগে নিতে পারবেন। উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে কবিতাগুলোর সৌগন্ধ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে পারবেন। আধুনিক মননশীল পাঠকের উপযোগী এই কাব্যগ্রন্থ বুদ্ধিদীপ্ত নতুন প্রজন্মের নিকট আদরণীয় হবে এই কামনা করি।


# প্রথম প্রকাশিত: গ্রন্থগত

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?