তপন স্যার ও তাঁর গ্রন্থ | রা ই বাবু

তপন স্যার ও তাঁর গ্রন্থ | রা ই বাবু

অধ্যাপক তপন কুমার রুদ্র এদেশের উত্তর জনপদের অন্যতম শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, সুবক্তা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক ছিলেন৷ এখন পর্যন্ত তাঁর মতো চিন্তাশীল ও সাংস্কৃতিক সংগঠকের অভাব অনুভব করে এই জনপদের মানুষ৷ তবে সাহিত্য জগতে তাঁর আগ্রহের মাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি ছিলো৷ তরুণ প্রজন্মের সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সাহিত্য অনুরাগীদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে পরিচিত তপন স্যারের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে লেখালেখি ও প্রকাশনাকে কেন্দ্র করে৷ ইংরেজি সাহিত্যের পাঠদানশৈলী আর বাংলা সাহিত্যে তাঁর দখলদারিত্ব ছিলো ঈর্ষণীয়৷ কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ লিখেছেন অনেক৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে তাঁর অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প৷ তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ ও উপন্যাসের বেশ কিছু গ্রন্থও প্রকাশ হয়েছে বিভিন্ন সময়ে৷

অধ্যাপক তপন রুদ্রের প্রথম কবিতা গ্রন্থের নাম 'কবিতায় শ্রেণীঘাত', প্রকাশ হয়েছিলো ২০০৭ এর ফেব্রুয়ারিতে৷ জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে এই কবিতার বইটি প্রকাশ করা হয়েছিলো৷ রংপুর শিল্পকলা একাডেমিতে এই গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন ও প্রকাশনা উৎসব হয়েছিলো৷ কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার এই উৎসবের মূল বক্তা ছিলেন৷

স্যারের দ্বিতীয় গ্রন্থটি ছিলো ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ ও বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধ সংকলন৷ প্রকাশনী সংস্থা পাঠক সমাবেশ সংকলনটি 'সীমানার সাথে যুদ্ধ' শিরোনামে প্রকাশ করেছিলো ২০০৮ এর একুশের বই মেলায়৷ এই গ্রন্থটির রিভিউ আলোচনা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিলো কুড়িগ্রাম জেলা পরিষদে ২০০৯ সালে৷ এ দেশের প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, গবেষক ও ২১'র পদকপাপ্ত লেখক অধ্যাপক যতীন সরকার প্রধান আলোচক ছিলেন এই অনুষ্ঠানে৷

এর পরে স্যারের ইচ্ছে হলো তাঁর বিশেষ মুহুর্ত ও প্রেক্ষিতে লিখা তেরটি কবিতার সমন্বয়ে একটি অনুগ্রন্থ প্রকাশ করার। বিশেষ এই কবিতাগুলো স্যার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মজীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন৷ এই কবিতাগুলো প্রকাশ করার আগ্রহটা বেশি ছিলো স্যারের৷ আবার মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন। অপরদিকে প্রকাশনীকে আগে থেকেই জমা দেওয়া একটি উপন্যাসের পান্ডুলিপি নিয়েও স্যার বিপাকে ছিলেন৷ পাঠক সমাবেশের প্রকাশক এস আই বিজু ভাই উপন্যাসটি প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করছিলেন আগে থেকেই৷ কিন্তু স্যারের মনের চাওয়াটা ছিলো কবিতার বইটি আগে প্রকাশ হোক ৷যাহোক, অবশেষে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী থেকে 'মাকে বলা আমার কিছু মিথ্যে কথা' শিরোনামে তেরটি কবিতার সমন্বয়ে একটি অণুগ্রন্থ প্রকাশ করা হলো ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে৷ এরপর ২০১০ এর একুশের বই মেলায় পাঠক সমাবেশ থেকে স্যারের প্রথম উপন্যাস প্রকাশ করা হলো৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শরণার্থী শিবিরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা ও মুক্তি সংগ্রামের প্রেক্ষিতে লেখা এই উপন্যাসের নাম 'অংশী'৷ এই উপন্যাসের একটি রিভিউ আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছিলো কুড়িগ্রাম তেরেডেস হোমস্ মিলনায়তনে৷ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সরিফা সালোয়া ডিনা ছিলেন এই অনুষ্ঠানের মূল আলোচক৷

এরপর স্যার অসুস্থ হয়ে পরলেন৷ তবু তার লেখালেখি বন্ধ ছিলো না৷ পরবর্তীতে ২০১১ এর একুশের বই মেলায় পাঠক সমাবেশ থেকে আরেকটি প্রবন্ধের বই প্রকাশ হয়৷ বাংলা-বাঙালি, সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে এই প্রবন্ধ সংকলনটি প্রকাশ হয় 'প্রাক পরিচয়' শিরোনামে৷ এরপর ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্যারের আরেকটি কবিতার বই প্রকাশ হয়৷

কর্মজীবন শেষে অধ্যাপক তপন রুদ্র স্যার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিরামহীনভাবে উত্তর জনপদের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন৷ কুড়িগ্রাম উদীচীর সভাপতি ছিলেন এবং কেন্দ্রীয় উদীচীর সহসভাপতিরও দায়িত্ব পালন করেছেন বহু বছর৷ ছাত্র জীবনে সফল ছাত্রনেতা হিসেবেও বেশ খ্যাতি ছিলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ আর কর্মজীবনে একজন সফল ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে আজও শ্রদ্ধাভাজন হয়ে রয়েছেন দেশজুড়ে৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?