পরিমিতিবোধ ও মানবিকতায় উজ্জ্বল নক্ষত্রসম কবিঃ মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান

 

পরিমিতিবোধ ও মানবিকতায় উজ্জ্বল নক্ষত্রসম কবিঃ মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান

বাদল সাহা শোভন সম্পাদিত ‘কাঠপোকাদের দখলে নীরবতার আশ্রম’ কবিতার বইটিতে কবি জুলকারনাইন স্বপনের ‘ভাবনাহীন’, ‘কষ্টের ফেরিওয়ালা’, ‘আসন্ন’, ‘নিজেকে আঁকি’, ‘জীবনের খোঁজে’ নামক পাঁচটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। জীবনঘনিষ্ঠ প্রতিটি কবিতাতেই কবি জীবনের অতল গহীনের হাহাকার, হতাশা, দৈনন্দিন পোড় খাওয়া প্রত্যাশা, কবি মনের অতৃপ্তি এবং বিস্মৃতপ্রায় প্রেমের কল্পনার বর্ণনা এঁকেছেন। ‘ভাবনাহীন’ কবিতার শুরুতে কবি লিখেন-


ঘোর অন্ধকার রাত্রি পেরিয়ে

একটি উজ্জ্বল সোনালী দিন চাই।


বর্তমান অসুস্থ জটিল সভ্যতার অভিশাপে কবিচিত্ত বিদীর্ণ ও অবসন্ন। নিজের অন্তরে তিনি প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করেন একটি আলোকোজ্জ্বল সোনালী দিনের। সমাজ সংসার তথা সত্তা বিচ্ছিন্নতার অন্তর্বেদনায় নিমজ্জিত কবি- ঘোর অন্ধকার হতে বিচ্ছিন্ন হতে চান, বেরিয়ে আসতে চান এই তথাকথিত সামাজিক, মায়াময় মাকড়সা জালের আবরণ থেকে। বিষন্নতার জলাধারে আত্মসমাহিত হতে চান না তিনি। অন্ধকার রাত্রি পেরিয়ে উজ্জ্বল আলোর প্রত্যাশা- তাঁর ব্যক্তি চেতনারই শৈল্পিক প্রতিভাস।


কবির এই প্রত্যাশার ব্যাপ্তি প্রতিটি জীবনের দৈনন্দিন প্রত্যাশা। আমরা কেউ বুঝি ভালো নেই! জগৎময় এত চাকচিক্য, প্রতিনিয়ত নিয়ন বাতির আলোয় ফুটে ওঠা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলজ্বল করে আলোক ছড়ানো আতশবাজী রাতের আঁধার পাঠায় হয়তো- ঘোর অন্ধকার কাটাতে পারে না জীবনের। লক্ষ কোটি তারা পূর্ণিমার রূপালী আলো ছাপিয়েও ঘোর অন্ধকার থেকে যায় মনের গহীন অতলে। আলোর বিছানাতে শুয়েও মানুষের নিত্যদিনের প্রত্যাশা- একটি উজ্জ্বল সোনালী দিনের। তাই কবি লিখেন-


বিস্তীর্ণ মরুভূমি পার হয়ে

আকণ্ঠ ঠাণ্ডাজল চাই।

অ-কুল নদী সাঁতরিয়ে

একটি তীর চাই।

শীতল হাওয়ায় শান্তির পরশে

একটু ঘুমোতে চাই।

গভীর ঘুম। দুঃস্বপ্নহীন ঘুম।


উপর্যুক্ত অংশে মরুভূমি, ঠাণ্ডাজল শব্দদু’টি তাপদাহের শেষে ওষ্ঠাগত প্রাণের অন্তিম প্রত্যাশা মনলোকে প্রতিভাত হয়।


‘অকূল নদী সাতরিয়ে একটি তীর চাই’ -এ প্রত্যাশা কবির একার নয়। জীবন নদী বড়ই বিচিত্র। অতল গভীরে ডুবসাঁতারে বহুদূর পথ পেরিয়ে গেলেও সহজে শেষ হয় না পথ। হাঁটুজলে পৌঁছার পর অতলান্তের ক্লান্তিতে হাঁটু নুয়ে আসে, আবছা আলোয় নিকটবর্তী তীর ক্রমশ দূরে সরে যায়। ওষ্ঠাগত প্রাণ তীরে পৌঁছানোর আশায় ব্যাকুল হয়। তীরে পৌঁছে গা এলিয়ে ঘুমোতে চান কবি। তিমির রাত্রি পেরুনোর পরে যে ঘুম। বিস্তীর্ণ মরুভূমির তপ্ত বালুকারাশি খালি পায়ে ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। সেই জীবন নদী সাঁতরে কিংবা জীবনের বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা পেরিয়ে আসার পর শীতল হাওয়ায় শান্তির পরশে একটু ঘুমোতে চান কবি।


কবির ‘ভাবনাহীন’ নামক কবিতাটির ব্যাপ্তি অনেক বিশাল। এখানে সস্তা প্রেমের সুড়সুড়ি নেই। কারও জন্য অপেক্ষার কিংবা প্রত্যাশার বিশাল বর্ণনা নেই। নির্দিষ্ট এবং পরিমাপক কিছু শব্দে মানুষের যাপিত জীবনের সর্বোচ্চ প্রত্যাশাকে তুলে ধরা হয়েছে। জীবনের কাক্সিক্ষত সীমানায় পৌঁছে হলেও প্রত্যাশিত ন্যুনতম স্বস্তির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কবি।


কবিতার শেষাংশে এসে কবির আশাবাদ এবং কবিতার নামকরণে বিস্তর ফারাক লক্ষচ্যুত হয় না। কারণ জীবনের দীর্ঘশ্বাস থাকবেই- ভাবনাহীন জীবন অকল্পনীয়। তাছাড়া আমার মনে হয়- দীর্ঘশ্বাস এর বয়সটা পৃথিবীর চাইতেও বেশি। প্রাণের পরে প্রাণে বয়েও সে সবল, সতেজ চিরযৌবনা মহিষী।


একজন আগাগোড়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জুলকারনাইন স্বপন। পরিমিতিবোধ ও মানবিকতায় উজ্জ্বল নক্ষত্রসম। সাহিত্য এবং সংস্কৃতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। প্রচণ্ড পরিশ্রমী একজন নাট্যাভিনেতা, নির্দেশক এবং সংগঠক জুলকারনাইন স্বপন খুব সহজেই কাউকে আপন করে নেওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ধারণ করেন। তাঁর মতো সত্যিকার সংস্কৃতিমান মানুষের সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ অব্যাহত থাকুক। তিনি থাকুন আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?