হেলাল জাহাঙ্গীরের কবিতার বই ‘প্রেম বৃক্ষের ফল’ - নুসরাত জাহান

 

হেলাল জাহাঙ্গীরের কবিতার বই ‘প্রেম বৃক্ষের ফল’ - নুসরাত জাহান

সাহিত্যপ্রেমী মানুষ হেলাল জাহাঙ্গীর। লেখালেখি শুরু করেন সেই আশির দশক থেকে। জীবনের বিভিন্ন সময়ে রচিত সর্বমোট ৪৬টি কবিতা নিয়ে ‘প্রেম বৃক্ষের ফল’ কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ।


পৃথিবীতে বাংলা একমাত্র ভাষা, যেটি রক্ত দিয়ে কেনা। ভাষা শহীদদের বীরত্বের লড়াই আর উজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে রচিত বইটির প্রথম কবিতা ‘রক্তে ভাষার টান’। কবি ছন্দে ছন্দে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে বলেছেন। স্বাধীন দেশে বসবাস করেও শ্রেণি বিভক্তি কবিকে মর্মাহত করে। তিনি লেখেন-


 দেশটা শুধু হয়েছে মুক্ত

সমাজ কিন্তু শ্রেণী বিভক্ত

শোষিত মানুষ পুঁজিবাদের কলে!

হৃদয়জুড়ে- ত্রিশ লক্ষ প্রদীপ জ্বলে!!


কবি যেমন সবসময় সাম্যের স্বপ্ন দেখেন, তেমনি সাম্য প্রতিষ্ঠায় লড়াই চালিয়ে যাবার অঙ্গিকারও করেন। ‘আ’মরি বাংলাদেশ’ কবিতায় তিনি লেখেন-


আমাদের সংগ্রাম চলছেই চলবে

চেতনার অনল সেতো জ্বলছেই জ্বলবে

শোষিতোরা অবশেষে শোষকদের করে দেবে শেষ

সাম্য আলোয় সমৃদ্ধ হবে আ'মরি বাংলাদেশ।


বদলে যাচ্ছে সমাজ, বদলে যাচ্ছে সংস্কৃতি। হীনস্বার্থের মুখোশ পরে মানুষ আজ ক্রমেই দুরে সরে যাচ্ছে। রংহীন ফ্যাকাসে হচ্ছে প্রেম কিংবা ভালবাসা। ‘বদল তন্ত্র’ কবিতায় সমাজ বদলের এই বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি আরও বলেন-


বদলে যাচ্ছে যে যার মত করে

নেই দর্শন, নেই আদর্শ, নেই বিবেকের চর্চা

অযথা চলছে সময় অপচয়-

শক্তির ক্ষয়

বাড়ছে শুধু জীবনের ব্যায়-ব্যাধি আর খরচা!


জন্মভূমির প্রতি গভীর টান থেকে কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত দুটি কবিতা স্থান পেয়েছে বইটিতে। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে কুড়িগ্রামের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা করে সকলকে জেগে ওঠার আহ্বান জানান। কবি দুঃখ দুর্দশা মুক্ত কুড়িগ্রাম প্রত্যাশা করেন। আবার সেই আঞ্চলিকতার রেশেই নিজের সম্পর্কে বলেন-


কুড়িগাঁওয়ের কুড়িয়্যা মুঁই

মানবতা মোর ধর্ম

প্রেম ভালোবাসা অন্তরে মোর

জানোঁ স্বরূপের সারমর্ম!


আত্মপ্রাণের মূলের সাথে পরিচয় না থাকায় কত প্রাণ যে বিফলে যাচ্ছে! অন্যদিকে কার থেকে কে বড় সেই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে কাঠ চেড়ার মত সভ্যতা আজ ফাঁড়াই হচ্ছে। এই সবুজ শ্যামল পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ; যুদ্ধের দামামা বাজছে। শান্তিপ্রিয় কবি হেলাল জাহাঙ্গীর তার কবিতায় এসব রুখে দিয়ে পৃথিবীময় শান্তির আবাদ করার আহবান জানান। বরাবরই কবি কালো অন্তর, কারো প্রতি আক্রোশ কিংবা প্রতিশোধ পরায়ণতার বিরুদ্ধে। 


আমরা একই পৃথিবীতে বাস করি, সবাই একই রকম শ্বাস ছাড়ি। কিন্তু তবুও কেন আমাদের মাঝে এত দূরত্ব? এই প্রশ্নের যেনতেন উত্তরে কবি নন সন্তুষ্ট। বিশ্বজুড়ে পরম শান্তি তার চাওয়া। কবি ‘ঠন্-ঠনা-ঠন-ঠন’ কবিতায় আমিত্বকে বিসর্জন দেওয়া  আদর্শহীন সমাজের কিছু মানুষের বর্ণনা দেন যাদের ফলাফল শেষে শূন্য।


বইটির শেষের দিকের বেশ কয়েকটি কবিতায় কবি ‘কবিতা’কে বিশেষভাবে তুলে ধরেছেন। জ্ঞান, বিস্ময়, প্রেরণা যোগাতে, উৎসাহ কিংবা স্বপ্ন দেখাতে বারবার কবি কবিতার প্রতি গুরত্বারোপ করেছেন। কবি লিখেছেন-


তুমি আমার ভালোবাসার

তুঙ্গে বাজা বাঁশি

তুমি আমার প্রেম সাধনার

কবিতা উর্বশী!!


এরকম কিছু লাইনে কবি শুধুই কবিতাকে সম্মোধন করেছেন নাকি কবিতা হিসেবে তার প্রেয়সীও স্থান পেয়েছে পাঠক হৃদয়ে সে বিষয়ে দ্বিধা থেকে যায়। যদিও কিছু কিছু কবিতায় সরাসরি প্রেমের উজ্জ্বল প্রকাশও লক্ষ্য করা যায়। অবশেষে কবি তো বলেই দিয়েছেন যে তার প্রেম বৃক্ষের ফল হল কবিতা। যেটির নামে বইটির নামকরণ করা হয়েছে।


হৃদয়ে, চেতনায়, মননে, মানসে যিনি কবিতাকে ধারণ এবং লালন করেন তিনি কবি হেলাল জাহাঙ্গীর। শুধু কবিতার মধ্যেই তাঁর লেখালেখি সীমাবদ্ধ নয়, তিনি একজন শক্তিশালী নাট্যকারও বটে। পরিশেষে সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে তার পদচারণা অব্যাহত থাকুক। তার লেখনী আমাদের সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণের পথ নির্দেশক হোক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?