নভোগৃহে জন্মান্তরিত কবি মিজান খন্দকার - সাম্য রাইয়ান

নভোগৃহে জন্মান্তরিত কবি মিজান খন্দকার - সাম্য রাইয়ান


    কুশল-রঙের জ্যোৎস্নার আবহে

    জন্মান্তরিত হবো আমি, হবো জ্যোতিষ্ক-নাগরিক।


‘জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে’ কবিতায় এমনটাই লিখেছিলেন কবি মিজান খন্দকার। ২৫ এপ্রিল রাত এগারোটার দিকে খবর পেলাম— মিজান ভাই আর নেই! খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম! বুঝতে পারছিলাম না এখন আমার কী করা উচিৎ। কাউকে ফোন করে খবরটা জানাবো। না কি মিজান ভাইয়ের নম্বরে ফোন করবো? এসব মনে হচ্ছিলো! রংপুরে দুই সপ্তাহ চিকিৎসার পর জিবিএসে আক্রান্ত তাঁর দুর্বল শরীরকে করোনার কাছে পরাজিত হতে হলো। রাত সাড়ে বারোটায় জুলকারনাইন স্বপন ভাই ফোন করে বললেন, ‘সাম্য খবর শুনেছো?’ বললাম, ‘জ্বি ভাই।’ মৃদু স্বরে বললেন ‘আচ্ছা’। লাইনটা কেটে গেল। বুঝলাম, কথা বলার অবস্থায় নেই তিনিও! গলা ধরে আসছিলো। মনে পড়ছিলো আড্ডার স্মৃতি আর তাঁর কবিতার পংক্তি:


    একদা যে ধুলোগৃহে আমিও ছিলাম

    করি আজ অবধান সেই ধুলিধাম।


২.

কবি মিজান খন্দকার জন্মগ্রহণ করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জে, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর। পিতার চাকুরীসূত্রে ঘুরে বেরিয়েছেন দেশের নানা অঞ্চলে, পাহাড়ে সমতলে। এভাবেই ১৯৭৫ এ চলে আসেন বাঙলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামে। বাকি জীবন কাটে নদীঘেরা এই কুড়িগ্রামে। নদীর সতত উচ্ছল তরঙ্গমালার অনুপ্রেরণায়ই হয়তো তার কবিতা হয়ে উঠেছে প্রান্তরের গান; নদীর প্রবাহের মতো সরল। “তার ছন্দে প্রেম, প্রকৃতি, মানবিকতা দুলে ওঠে একই অঙ্গে নানা ভঙ্গিমায়। ফলে বাঙলাদেশে এক প্রান্তে বসে রচিত কবিতা নাড়িয়ে দিতে পারে বাঙলার যে কোনো প্রান্তের পাঠককে।” অনিবার্য ভঙ্গিমায় কুড়িগ্রাম উঠে আসে তার কবিতায়-


    কোত্থেকে যে আসে ঢেউ! সেই অভিঘাতে প্রথম বিশ্বের

    দোষ-ত্রুটি এসে লাগে তৃতীয় বিশ্বে, কুড়িগ্রামের শীতাইঝাড় গ্রামেও।

    (প্রথম বিশ্বের দোষ-ত্রুটি এসে লাগে শীতাইঝাড় গ্রামেও/ জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)


৩.

মিজান খন্দকারের প্রথম বই ‘যথা কবি নিরঞ্জন’, প্রকাশিত হয় ২০০৪ এ বুকক্লাব থেকে। নব্বই দশকে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটলেও প্রথম বই প্রকাশে তিনি সময় নিলেন প্রায় দেড় দশক। আর তাই এ বইতেই তিনি বোদ্ধা পাঠকের কাছে যেন দাবিদার হলেন স্বকীয় মর্যাদার। ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনা তার কাছে ভাষা পেয়ে হয়ে উঠলো নৈর্ব্যক্তিক। তাঁর উপমা তথা চিত্রকল্পগুলো আমাদেরকে কবিতায় নতুন স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ করে দিলো।


    শুশ্রূষা করবে ভেবে ছুটে আসে নার্স। ডেটলবিধৌত দেহ হতে

    রূপ যেন ছিটকে ছিটকে পড়ে

    চতুর্দিকে। তাকে দেখে মজে পুঁথির কুমার।

    (ভাসান/ যথা কবি নিরঞ্জন)


স্বদেশের অন্তর্জ্বালা, সমাজের অসঙ্গতি কবিকে ব্যথিত করে। তারই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় কবিতায়-


    পশ্চিমপ্রবণ বায়ু হতে কতো ধর্মযুদ্ধ

    বাণিজ্য সন্ত্রাস এবং নিবিড় মেদের গদ্য ছড়িয়ে পড়ছে

    ফসলের নব-উদ্ভাসিত প্রকরণে।

    (যথা কবি নিরঞ্জন)


জীবনের শত ব্যর্থতা, হাহাকার, দেশ-কালের লাঞ্ছনাকে আড়াল করতে তিনি ফিরে ফিরে আসেন বাঙলার পুরান পুঁথির কাছে।


৪.

২০০৯ এ প্রকাশিত হয় মিজান খন্দকারের চারটি গল্পের সংকলন ‘পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ’। এ বইয়ে আমরা তাকে এমন রূপে পাই, যিনি স্বপ্ন দেখেন, পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ নামবে যুদ্ধে, স্বাধীনতার চেতনা বুকে গড়বে নতুন মানবিক বাংলাদেশ। এ বইয়ের গল্পে উঠে এসেছে নদী, নারী, যন্ত্রের কাছে মানুষের পরাজয়, চর দখলের লড়াইয়ের দৃশ্য। যন্ত্রের কাছে পরাজিত মানুষ- মানুষেরই কাছে নিগৃহীত, নিস্পেষিত। কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ধরলা তীরের জীবনবাস্তবতার অনুপম আলেখ্য ‘দখল’। আবার তিনটি পরিচ্ছদে ভাগ করে পঁয়ত্রিশটি বিচ্ছিন্ন দৃশ্যের কোলাজ নামগল্প ‘পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ’। এর নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি ভালো লাগে। পড়তে পড়তে পাঠক নিজেকেই যুদ্ধার্থী হিসেবে আবিষ্কার করতে পারেন...


এরপর কুড়ি জন বাসযাত্রীর পঞ্চাশটি ভিন্ন ঘটনা প্রবাহ ও আলাপচারিতার গল্প ‘একটি দূরপাল্লার কোচ ও গতির অভ্যন্তরে কিছু বহুভেদক প্রাণ’।


এ বইয়ে কাল্পনিক গল্প নয়, লেখক যেন এই সমাজের দগদগে ঘা সূর্যের আলোতে মেলে ধরেছেন। ফলে এই সমাজব্যবস্থার প্রতিই বিবমিষা তৈরি হতে পারে পাঠকের! লেখক লেখেন, “তথাপি এ কাহিনী শেষ হয় না...”। সত্যিই কি তাই? এ কি সেই গল্প, যে গল্পের শেষ নেই? আর সেজন্যই কি তিনি পরবর্তী বইয়ের নাম দিলেন ‘জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে’। এটি তাঁর শেষ বই, কবিতার। জয়তী প্রকাশনী থেকে ২০১১ এ প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের ফ্ল্যাপে টোকন ঠাকুর লিখেছেন,


    কাব্যের সৌন্দর্য নির্মাণে মিজান খন্দকার বাংলা কবিতায় ইতোমধ্যেই এক নিমগ্ন ভাষার জন্ম দিয়েছেন। ... নিরন্তর বদলে যাওয়া বাংলা কবিতার শব্দ-বাক্য-ভঙ্গিতে মিজান খন্দকার একজন সমুজ্জল কবি।


এ বইয়ের অন্দরে প্রবেশ করে আমরা খোঁজ করি সেই নিমগ্ন ভাষার। দেখি সেইখানে প্রেম আর প্রকৃতি মিশে একাকার।


    এইভাবে বলো যদি, ধরো যদি বলো, ‘চাঁদের বর্ণনা লেখা

    শেষ হলে

    তারপরও কিঞ্চিৎ জ্যোৎস্না

    যদি হাতে থাকে দেবো তোমাকেও।’

    (জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)


অথবা-


    যে দিকেই যাই, সেই পথ জুড়ে

    দাঁড়িয়ে থাক যে তুমি,

    তখন তোমাকে যদি ছুঁয়ে দেই

    হয়ে যাও বনভূমি।

    বনভূমে আছে নীল জলাশয়

    বলে গেল এক পাখি,

    সেই জলে ডুব সাঁতারের ছলে

    তোমাকেই শুধু আঁকি।

    (প্রাকৃতিক/ জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)


এই বইয়ে আমরা কবিকে আরও নিসর্গপ্রেমীরূপে আবিষ্কার করি। অধিকাংশ কবিতাতেই দেখা যায়, প্রকৃতির প্রতি প্রেম। প্রকৃতির গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনই যেন তাকে জন্মান্তরিত হতে প্রাণিত করে বারবার। কবিতায় তাই নিত্য উঠে আসে শস্যলুপ্তদিনের কথা, নদী-বন-ধানক্ষেতের কথা, শীত-বৈশাখ-বর্ষা... ঋতুর কথা; আর সেই জলের কথা-


    জলের প্রতিভা দেখে বিস্ময়-আবেগে একদিন

    অতল কুড়িয়ে তুলে দিকচক্রবালে ফুটে উঠে

    ছড়িয়ে দিয়েছিলাম প্রবল মুগ্ধতা।

    (ভ্রমণ-৩/ জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)


জলের প্রতিভায় বিস্মিত কবি তাই জলের কথা বর্ণনা করেন নানারূপে। আমরাও কবির চোখে জলের অফুরন্ত বিস্ময়দৃশ্য আবিষ্কারে অভিভূত হই-


    নিচে জলগৃহ, গৃহতে অফুরন্ত বিস্ময়; সাগর-সংশ্লিষ্ট

    এই দৃশ্যে

    ঢেউ শীর্ষে ক্ষুধা-রঙে কিছু ধানের স্বপ্ন আঁকতে

    চেয়েছিল যে নাবিক;

    দক্ষিণ-প্রবণ

    প্রবল বাতাসের সঙ্গে সংঘর্ষে

    বিধ্বস্ত হয়েছে তার

    জলগৃহযান।

    (ভ্রমণ-২/ জন্মান্তরিত হবো কোনো নভোগৃহে)


জল দ্বারা আলোড়িত কবি তাই শূন্য দশকের শেষ দিকে তার সম্পাদিত লিটলম্যাগের নাম দেন ‘জলগৃহ’। এক ফর্মার এই লিটলম্যাগটির দুইটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ এর জানুয়ারি মাসে সুশান্ত বর্মণের উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় এটি অনলাইনে নবরূপে যাত্রা শুরু করে। অনলাইনে একটি সংখ্যা প্রকাশের পর এটিও আর প্রকাশিত হয়নি। তবে সম্প্রতি তিনি আবার এটি প্রকাশের পরিকল্পনা করছিলেন। শূন্য দশকের শুরুর দিকে তিনি ‘শিলালিপি’ নামে একটি সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করেছিলেন। মূলত নব্বই আর শূন্য দশকের অনেকখানি জুড়ে ছিলো তাঁর শারীরিক সক্রিয়তার কাল। তার পরে শারীরিকভাবে ভেঙে পড়লেন, আগের মতো বাইরে, মঞ্চে, আড্ডায় আসতেন না। নিজেকে অনেকটাই ঘরবন্দী করে ফেলেছিলেন তিনি। নিজের লেখালিখি নিয়েই থাকতেন। আমাদের বাসস্থান কুড়িগ্রামে পাশাপাশি গ্রামে হলেও স্থানীয় সাহিত্য রাজনীতির কারণে ২০১৭-র আগে কখনো সেভাবে আড্ডা দেয়া হয়ে ওঠেনি। অথচ ২০১৭ এ হঠাৎ জেলা পরিষদের সামনে দেখা, সেই দিনই হলো অনেক কথা। আবেগাপ্লুত হলেন তিনি। জানালেন, আর কোনো মফস্বলীয় সাহিত্য রাজনীতির দাসত্ব নয়, আর কোনো বিরতি নয়। কাজ করতে চান নবউদ্যমে। আমার সহযোগিতা চাইলেন। আমিও অবলীলায় সহযোগিতা করতে চাইলাম। এরপর কতদিন ঘোষপাড়া ও কলেজ মোড়ে চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়েছি আমরা! জেনেছি তার কত পরিকল্পনার কথা! সর্বশেষ, নাটক লিখছিলেন কুড়িগ্রামের সেইসব মানুষকে নিয়ে, যাঁরা জীবিকার প্রয়োজনে পরিযায়ী পাখিদের মতো ঘোরে এক জেলা থেকে অন্য জেলায়! সেই নাটক মঞ্চস্থ হবার আলাপও চূড়ান্ত হয়েছিলো প্রচ্ছদের সাথে। কিন্তু তা আর হলো না; করোনায় আমরা হারালাম কুড়িগ্রামের অন্যতম একজন স্মার্ট ও আধুনিক চিন্তার কবিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?