অংশীঃ অশোকের চোখে একাত্তরের শরণার্থী শিবিরের চিত্র ও দুই দেশের সুবিধাভোগীদের মুখোশ উন্মোচন | জরীফ উদ্দীন

অংশীঃ অশোকের চোখে একাত্তরের শরণার্থী শিবিরের চিত্র ও দুই দেশের সুবিধাভোগীদের মুখোশ উন্মোচন | জরীফ উদ্দীন


শ্রীশচন্দ্র দাস তাঁর সাহিত্য সন্দর্শনে উল্লেখ করেছেন, “গ্রন্থাকারের ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন ও জীবনাভূতি কোনো বাস্তব কাহিনী অবলম্বন করিয়া যে বর্ণনাত্মক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয়, তাহাকে উপন্যাস কহে।” সত্যিকার অর্থে তাই দেখা যায় উপন্যাসে। বাংলা উপন্যাসের জন্ম খুব বেশি দিন হয়নি তারপরেও এই অল্প সময়ে অবস্থান করে নিয়েছে পাকাপোক্ত ভাবে। উপন্যাসের একটি শাখা ঐতিহাসিক উপন্যাস। ঐতিহাসিক উপন্যাস রচিত হয় কোন ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে। ঐতিহাসিক উপন্যাসের স্বার্থকতা হলো ইতিহাসের কোন ঘটনা বিকৃত না করে শিল্পসৌকর্যের মাধ্যমে কাহিনী ও চরিত্র নির্মাণ। তবে একটি কথা মনে রাখা জরুরী ঐতিহাসিক উপন্যাস কিন্তু ইতিহাস নয়। বঙ্কিম, রবীন্দ্র, কেরী, প্রমথনাথ, নারায়ন প্রমুখ লেখকেরা ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখলেও বাংলাদেশে ঐতিহাসিক উপন্যাসের বেশির ভাগ রচিত হয় একাত্তর পরবর্তীতে মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।

তপন কুমার রুদ্র রচিত 'অংশী' উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ, শরণার্থীদের জীবন ও নারী-পুরুষ রহস্যভিত্তিক উপন্যাস হিসেবে দাবী করেছেন লেখক নিজেই প্রচ্ছদে এই কথা উল্লেখ করে। লেখক উপন্যাসটি লিখতে গিয়ে তত্ত্ব ও তথ্যের জন্য ছুটে গেছেন বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকের কাছে, ইতিহাস গ্রন্থের দ্বারস্থ হয়েছেন যা অস্বীকার করেন নি।

অংশী উপন্যাসের নায়ক অশোক। আত্মভোলা হিসেবে উপন্যাসের প্রথমে তাকে উপস্থাপন করেন লেখক। সারা রাত ট্রেন জার্নির ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে চা পান করতে অচেনা যুবতির চাহনি অশোকের মনও ভালো করে দেয়। তাও আবার দুজন মেয়ের। সব উপেক্ষা করে দুই হাতে বড় সুটকেস নিয়ে যখন সে প্লাটফম থেকে বাহির হচ্ছিলেন সেই সময় সেই যুবতীর ডাক তার মনে কেড়ে নেয়। মেয়ে দুজন আসে যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এসে অশোকের ফেলে আসা একটা খাম হাতে তুলে দেয়। খামটিতে ছিল তার চাকরীর এপয়েন্টমেন্ট লেটার, বাবা-মা, ভাই-বোনের ছবি। খাম ফেরত দিয়ে মেয়ে দুজন শিলিগুড়ির ট্রেন ধরে চলে যায়। শিলিগুড়িতে তাদের পিসিরা এসেছে জয় বাংলা থেকে কোন রকমে বেঁচে। অশোকের মনটা এখানেই নাড়া দেয়। মনে পরে তার বাবা, মা, বোন ও ভগ্নিপতি, বোনের ছোট একটি বাচ্চার কথা। জয় বাংলায় অবস্থান করছে তারা কি বেঁচে আছে? আর থাকলেও ভারতে এসেছে কি না।

অশোক পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়িতে মামা বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করে ভারতের রেল বিভাগে চাকরি পান। তার মামার আদি বাসস্থান পূর্ববাংলার (বাংলাদেশের) ঢাকার বিক্রমপুরের লৌহজং থানায়। তিনি মনে করতেন হিন্দুদের একদিন না একদিন ভারতে চলে যেতে হবে। লেখকের ভাষায়, “সব হিন্দুদের একদিন না একদিন ভারতে চলে যেতে হবে এটাই তাদের ধারণা।”

রেল বিভাগে চাকরী করলেও অশোকের মন কিছুতেই স্থির হয় না বাবা-মায়ের চিন্তায়। এমন কি মেঝ মামার মেয়ের বান্ধবী লীলাও তাকে আটকাতে পারে না। বরং সেই সহযোগিতা করে তার বাবা মাকে শরণার্থী শিবির থেকে খুঁজে আনতে। লেখক অশোকের সাথে লীলার কাটানো সময়গুলো খুব রোমান্টিক করেছেন অনেকটা বাংলা সিনেমার মতো। যা অনেক সময় একটু বেশি বেশি কিংবা দেখা দৃশ্য বারবার দেখানো মতো মনে হয়।

অশোক এক সময় সৈয়দ চাচার চিঠির মাধ্যমে জানতে পারে তার বাবা, মা, বোন, বোনের স্বামী ও বাচ্চা ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিয়ে রৌমারী হয়ে মানিকার চর অবধি পৌঁছতে পেরেছে। তার মানে ওরা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে গেছে এত দিনে। একদিন সবার কাছে বিদায় নিয়ে অশোক বেড়িয়ে পড়ে তার বাবা-মাকে খুঁজতে। লীলা ও তার বান্ধবী রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। লীলা বারবার মনে করে দেন কর্তব্যের কথা। অশোক ট্রেনে করে ধুবরি পৌঁছালে গল্পের রূপ অন্য দিকে মোড় নেয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের টাকা-পয়সা, সোনার গহনা স্বল্পমূল্যে ভারতীয় মারওয়ারী কিনে নেন। কিংবা মারওয়ারী বাবুর মতো অনেকেই। অশোক ধুবরি গিয়ে লীলার মায়ের দেওয়া ঠিকানায় উঠলে যা নিজ চোখে দেখেন তা অশোকের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করে। এখানে অশোক নয় যেন তপন কুমার রুদ্র নিজেই দেখেছেন এমনটাই মনে হয় হওয়াই স্বাভাবিক। ধুবরিতে কয়েকদিন থেকে অশোক চলে যান মানিকারচর। গিয়ে উঠেন শরণার্থী শিবিরের এক পিসির (পাতানো পিসি) তাবুতে। সেখান থেকে শরণার্থী শিবির কাম্পে গিয়ে পান লীলার চিঠি। বাবা মা ও বোনের কোনো সন্ধান পেতে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে খুঁজতে থাকেন তাদের। শরণার্থী শিবিরে গিয়ে মানুষের দুঃখ-কষ্ট, রোগ-শোক, চোখের সামনে প্রিয়জনদের মৃত্যু দেখে চোরের মতো জয় বাংলা থেকে পালিয়ে আসার কিংবা রাজাকার ও মুসলিম লীগারদের সাহায্যে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ ইত্যাদির করুণ কাহিনী শুনে অশোকের চোখে পানি চলে আসে। আবার যখন শোনে কারো ছেলে, কারো স্বামী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরের মতো যুদ্ধ করেছে তখন তার ভালো লাগে।

অশোক কয়েকদিন ধরে খুজে বাবা-মা-বোনকে না পেয়েও পিসি কাছে থেকে বিদায় নিয়ে কোথাও যান না। যার ফলে পিসির বড় ছেলের বউ লীলাবতী ভর্ৎসনা সহ্য করেও অশোক খুঁজতে যেতে দেরি করেন দূরের কাম্পে যেতে। যার কারণ লীলাবতী বৌদির প্রেমে পরে যান অশোক। কিংবা পরিবারটাকেই ছেড়ে যেতে কষ্ট হয় অশোকের।

দিন দশেক পরে সকল মায়ার অবসান ঘটিয়ে অশোক নতুন ঝুনারদেউল নামক জায়গার এক রিফুজি ক্যাম্পের দিকে পা বাড়ান। রাস্তায় এসে এক ভ্যানে উঠেন। সেখানে কুড়িগ্রামের দুজন লোক পান যারা ব্যবসায়ী। কথার কথায় অশোক জানতে পারে ক্যাম্পের বাজারে বাজারে সাধনা ওষুধ বিক্রি করেন। তারা এই ওষুধ চুরি করে এনেছে শহরের একটা দোকান থেকে। এদের ব্যবসা যে খুব ভালো চলছে তাও নয়। পানির দরে ওষুধ বিক্রি করে। এদের কাছে জানতে পায় তার বাবা, মা, বোন এসেছে কয়েকদিন হলো। আশে পাশে আছে হয়তো কোথাও। এমনকি বাজারে তার বোনের স্বামী গান গাইতেও পারে। লেখক কুড়িগ্রামের লোক দুজনের কথোপকথনে তুলে ধরেন আঞ্চলিক ভাষায় যা থেকে কুড়িগ্রামের ভাষার প্রতি তার টান অনুভব করা যায়।

ঝুনারদেউল পৌঁছে হোটেলে খেতে গিয়ে হোটেলের মালিক দেবদুলালের সাথে সাথে বিভিন্ন কথার শেষে অশোক তার কাম্পে ওঠেন। দেবদুলাল তার বাবা, মা ও অন্যান্যদের খুঁজে দেওয়ার আশ্বাস দেন। এরই মাঝে একদিন রৌমারী যান দেবদুলালের সাথে গিয়ে অনেক কিছুই বুঝতে পারেন না।

ফিরে আসার পর জানতে পারেন পশ্চিমদিকে মূল রাস্তার কাছাকাছি এক পূজারী ব্রাহ্মণের বাড়িতে দুইটা ভদ্র পরিবার উঠেছে তাদের মধ্যে একজন গান গেয়ে বেড়ায়। শুনে সারারাত ছটফট করে কাটায় অশোক। এই রাতে দেবদুলালের অস্থায়ী ক্যাম্প আগুন লেগে পুড়ে যায়। যা রীতিমতো খারাপ লাগে অশোকের এর ফলে দেবদুলালের কাছে যেতে তার ভয় হয়। অথচ সেই লোকটা তাকে দুপুরে ডেকে নিয়ে খাওয়ার সময় চিন্তা না করে খেতে তাগাদা দেন।

এরই মাঝে একদিন অশোক বাজারে যান তার বোন জামাইকে খুঁজতে। শুনেছে এই বাজারে সে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়। বাজারে তার বোনের স্বামীকে দেখেও চিনতে পারে না অশোক। আশাভঙ্গ হয়ে সে পশ্চিমের বাড়িতে খুঁজতে যান। গিয়ে দেখেন তালাবদ্ধ। রাতে আবার ফিরে আসেন দেব দুলালের ডেরায়। পরের দিন অশোক সেই বাড়িটিতে একদিন খুঁজে পায় তার মা ও বোনকে। অশোকের বাবা ও দুলাভাই এখানে এসে বসেই থাকেননি। এখানে এসেও তারা দেশ স্বাধীন করার ব্রত পালন করছেন। অশোকের দুলাভাই বিভিন্ন হাটে গান গেয়ে যা অর্থ পান তা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের হাতে তুলে দেন। অশোক লীলাবতীকে দেখানোর জন্য তার মাকে শিলিগুড়ি নিয়ে যেতে চান। একপর্যায়ে তার মা যেতে রাজিও হন। কিন্তু থাকবেন না বলে দেন। গল্পও শেষ হয় নাটকীয়ভাবে, 

....… তার পরেও আবার হিসাব করে। বারবার হিসাব করেও সে দেখে তার ছুটি বেশ ক’দিন আগেই শেষ হয়ে গেছে।

গল্পটিতে অশোক তার পরিবারকে খুঁজতে বের হলেও পরিবার খোঁজার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। গল্পে ধারাবাহিকভাবে আসে বিভিন্ন চরিত্র এবং গল্প এগিয়ে চলার সাথে সাথে সেগুলো মিলিয়ে যায়। গল্প পড়তে পড়তে গল্পের ভিতরেই প্রবেশ করতে হয় কারণ উপন্যাসের গল্প আর গল্প থাকে না। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটে যাওয়া ঘটনার নিখুঁত বর্ণনা হিসেবে চোখের সামনে দেখা দেয়। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে মনে হয় লেখক অশোকের কার্যকলাপে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন; কিংবা লেখকই অশোক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর দেখা ঘটনাপ্রবাহ পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন তিনি।

উপন্যাসের কোথাও কোথাও যেন গল্পের গতি থেমে যায় আবার গতি লাভ করে। এছাড়াও যুক্তবর্ণগুলো ভেঙ্গে যাওয়ায় দৃষ্টিকটু লেগেছে। আর একটা বিষয় আমার খারাপ লেগেছে অশোক যেখানেই যায় মেয়েদের প্রতি তার একটা আলাদা টান অনুভব করে যা অশোকের চারিত্রিক দুর্বলতা হিসাবে ফুটে উঠেছে। এত কিছুর পরেও উপন্যাসের গল্পটি চমৎকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক শুধু অশোকের শিলিগুড়ি থেকে ঝুনারদেউল পর্যন্ত আগমনের ঘটনাপ্রবাহ দেখাননি; তিনি দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রের কার্যকলাপ, জাতিসংঘের শান্তির আহ্বান। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধের বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যা গল্প হয়েও ইতিহাসের দাবী রাখে।


উপন্যাস : অংশী
লেখক : তপন কুমার রুদ্র
প্রচ্ছদ : সেলিম আহমেদ
প্রকাশক : পৃথ্বীশ প্রত্যয়, সমাবেশ।
মূল্য : ১৯৫ টাকা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?