‘অন্তর অতলে জ্বলে জীবন্ত স্বরূপ’ কবি হেলাল জাহাঙ্গীরের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। বইটি উৎসর্গ করা হয় যাঁরা প্রতিদানের আশা না করে আর্ত মানবতার সেবা করে তাঁদের প্রতি। কাব্যগ্রন্থটিতে মোট কবিতার সংখ্যা ৫১টি।
হেলার জাহাঙ্গীরের কবিতায় পাওয়া যায় একই সঙ্গে প্রেম ও স্বাধীনতার কথা। দুঃখ ও আশার কথা। বিদ্রোহ ও বিপ্লবের কথা। জাতিকে জেগে ওঠার ডাক। তিনি কখনো প্রেমের জন্য ব্যাকুল। কখনো স্বাধীনতার জন্য ক্ষ্যাপা বাউল। যা কবিতায় ফুটে উঠেছে নিপুণভাবে। কবির মানসপটে অঙ্কিত বাহান্ন, চুয়ান্ন, একাত্তর সহ বাংলার ইতিহাসের আলোচিত ও স্মরণীয় ঘটনার কর্মবিবরণ। যা কবিতাকে শুধু কবিতাই রাখে না। নিয়ে যায় ইতিহাসেও। এছাড়াও তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় সমাজের ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার সহজ স্বীকারোক্তি। কবির কিছু কবিতায় খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠে আঞ্চলিক ভাষার ঘ্রাণ। যা মনকে করে উদাস! অজান্তেই গেয়ে উঠতে হয়-
কান্দিস না ও-বউ, অমাত আসমানের মতন
ঢালিস্ না, ঢালিস্ না সিঁথানের বালিশের ফুলে
আর ঐ দুইচক্ষের জল, দোহাই লাগে যৈবন
জমিনের, দিস্না দোষ রাগে ও তাপে কিংবা ভুলে
নসিবের তামাম দিন-রাইত। মন দিয়া শোন
ধনতন্ত্রই দূশমন, জ্বালায়-পোড়ায়-ঠকায়!
উদরে উপাস! অবেলায় মউতের এ দংশন! (জন্ম-জন্মান্তর)
‘অন্তর অতলে জ্বলে জীবন্ত স্বরূপ’ বইয়ের প্রথম কবিতা ‘প্রেম শক্তি’তে প্রেমের জয়গান গেয়েছেন। প্রেমের শক্তি মানুষকে মোহিত না করে ছাড়বে না কবিই তাই যেন বলতে চেয়েছেন। এই শক্তির টানেই হয়ত মানুষ প্রেমে পরে। কাউকে দেখার তৃষ্ণা কবিকে জ্বলে-পুড়ে ছাই করে দেয় আর কবির আবৃত চোখ চেয়ে থাকে অন্তর দপর্ণে। কবিতার প্রিয়ার কাছে যাঞ্চা করে শক্তি ও উত্তাপ যার ফলে পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠে কবির মনঃস্তাপ ঘুচে যাবে। এমনই বার্তা পাই তৃষ্ণা নামক কবিতায়। যখন কবিতার প্রিয়তমাকে কসম করে দু’চোখে তাকাতে বলে এবং আদিম পাথর তার দিকে ছুঁড়তে বলে তখন বুঝা যায় কবিহৃদয়ের আকুতি। কবিতার প্রিয়তমার প্রেমে কতটা বিভোর।
তোমার কসম বালা একবার দু’চোখে তাকাও
আদিম পাথর না হয় মারো এ মরদের পানে
অবিশ্বাস করো বিহ্বলা বিশ্বাসের মাথা খাও
মুখে না ফুটলে কথা বলে যাও ইশারার টানে।
১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ সাল। বাংলার ইতিহাসে একটি কালো দিন। এই দিন নরপিশাচদের বুলেটে বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন। ফিনকি দিয়ে বয়ে যায় রক্তের ঢল। লাল হয় বাংলার মাটি। আকাশ ছেঁয়ে যায় শোকে। থমকে যায় বজ্রকণ্ঠ। যে মহান ব্যক্তিকে মারতে কেঁপেছিল পাকিস্তানের বুক। তাঁকেই হত্যা করলো বাংলা মায়ের সন্তানেরা। এর চেয়ে দুঃখ আর কি হতে পারে। কবির ভাষায়-
থমকে গেল মানবতা, স্তম্ভিত ইতিহাস
জেনোসাইড! জেনোসাইড!!
সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা হয়ে যাওয়া
এ যেন কালের ইতিহাসে দ্বিতীয় কারবালা।
... তারপর থেকেই সবুজ প্রান্তরজুড়ে
কাঁদে শোষিত মানুষ, কাঁদে মাটি, কাঁদে ইতিহাস! (রক্তে লেখা সবুজ ইতিহাস)
‘তুমিই অতঃপর’ কবিতায় কবি নিঃসংকোচে গেয়ে উঠেন কারো জন্য কবির স্মৃতির বাতিঘরে হঠাৎ করে দুটি কবুতর বাকবাকুম রবে গেয়ে উঠে। কাগজের অন্তরে হেসে উঠে লেখার কলম। স্বত্ত্বা ছুঁয়ে প্রতিনিয়ত প্রাণের আলো ঝরে পরে এবং চোখ বন্ধ করলেই কবিতাকেই দেখতে পায়। সে কে? বালা, সঞ্চিতা, কবিপত্নী না অন্য কেউ? বইজুড়ে এই প্রশ্ন থেকে যায়। কেননা কবি ‘আরশী অন্তর’ কবিতায় বলেন ‘বালা’কে। ‘বিশ্বব্যাপী হরতাল’ কবিতায় শোনান ‘সঞ্চিতা’কে। ‘জন্ম-জন্মান্তর’ কবিতায় কাঁদতে মানা করা বউকেই। কবি এদেরকেই যেন খুঁজে বেড়ায় বন-জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে, সূর্য অনলে, হাজার রাতে, আকাশে বাতাসে, গোপনে প্রকাশ্যে, রক্ত কণিকায়, শিরা-ফুসফুসে, স্বপ্ন সীমায়, কোটি জোতিষ্কে। অবশেষে কবিতাকে খুঁজে পায় ঘন আঁধারে আলোয় অবিনাশি প্রেমরূপে যে অনন্তকাল স্বরূপের শিখা জ্বেলে আসতেছে।
‘পবিত্র বিস্ময়’ নামক কবিতায় কবি হেলাল জাহাঙ্গীর চার স্বাক্ষী দিয়ে প্রেম করলেও অবশেষে নিজেই বলেন শর্ত দিয়ে প্রেম হয় না। কিন্তু প্রেম টেকাতে হলে প্রেমের ধর্ম মানা হয়। এটা যেন কবির কাছে মনে হয়েছে পবিত্র বিস্ময়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও কবিতার প্রিয়তমাকে বিচার দেন-
স্বাধীনতার আলো আজও
পৌঁছেনি সানকীতে সবার
রক্তের পর রক্তই শুধু
ইতিহাসে হচ্ছে জমা
জাতির স্বপ্ন-আশা পুড়ছে যে বারবার॥
বেড়েছে বেকারত্ব সন্ত্রাস
মাদকাসক্তি, খুন ও ধর্ষণ
ক্ষত-বিক্ষত সবুজ হৃদয়
পোড়ে প্রেম, পোড়ে শোষিত জীবন॥ (মহা আয়োজন)
এত কিছুর কি কোন সমাধান আদৌ আছে? প্রয়োজন কি মহান বিপ্লবের? তার প্রিয়তমাই ভালো জানেন। জন্মান্তর নামক কবিতায় খুব চমৎকারভাবে ফুটে তুলেন আমাদের দেশের কিছু মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি যা অনন্তকাল ধরে একই নিয়মে চলে আসতেছে। সহ্য করছে সেই একই কষ্ট। বছরের পর বছর যায়। ভোট আসে, নেতা আসে। ভোট শেষ ধনী আরো ধনী হয় কিন্তু ভাগ্য ফেরে না অভাগাদের। তারা দেশের ক্রান্তিকালে জন্ম জন্মান্তরের জীবন বিলিয়ে দেয় অকাতরে। এরা চায় শোষকের থেকে মুক্তি। মহাজনদের মহাকারবার থেকে মুক্তি। চেয়ে থাকে মহামানবের জন্য। সেই মহামানব কি আসবে? জন্ম নিয়ে এক নব ইতিহাসের? সব মিলে দূর্দান্ত কবিতা এটি। অনেকটা নাটকের ঢঙে সাজানো।
কবি মানবতার জয়গান গেয়ে যান বারবার। অন্যের দুঃখ ভুলে যান নিজের দুঃখের কথা। কাঁতর হন অন্যের বেদনায়। ‘ঈদের কান্না’ কবিতায় কবিতার জীবনে ঘটে যাওয়া এক ঈদের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। রুবেলের মৃত্যু সংবাদ ঈদের দিনে বিষাদের ছায়া ফেলে কবিমনে। শুধু কবিই কাঁদে না কাঁদে রুবেলের মা, বাবা, ভাই, বন্ধু, বোন, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা এমনকি সব আপনজন। হয়ত পাঠক হৃদয়ও কেঁদে ওঠে। কবির আফসোস আর কখনো রুবেলকে কোথাও খুঁজে পাবে না। রুবেল যেন কবির নয় আমাদেরই আপনজন হয়ে ওঠে বেদনার্ত করে হৃদয়কে।
বই এর শেষের নামকবিতা ‘অন্তর অতলে জ্বলে জীবন্ত স্বরূপ’ এ কবি সহজ স্বীকরোক্তি দিয়েছেন প্রভূর কাছে। যখন চারদিকে নিরবতা শুধুমাত্র প্রভূর কথাই মনে পরে কিংবা হৃদয়ের আকাশে তার রূপের আলো হাসলে প্রেমের ধুপ পোড়ে অথবা প্রাণের মূলে প্রভূর প্রেমের আওয়াজ তোলে রক্তে ঝরে টুপ্টুপ্ করে তখন কবির- “অন্তর অতলে জ্বলে জীবন্ত স্বরূপ” সব মিলে সুখপাঠ্য একটি কাব্যগ্রন্থ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?