হেলাল জাহাঙ্গীর: যে জীবন কবিতার - আশরাফ রাসেল

হেলাল জাহাঙ্গীর: যে জীবন কবিতার -  আশরাফ রাসেল

নাচে ফুলবন, নাচে দেহ মন- নাচে ভোর বিহানের মৌ!

নাচে কবি-নাচে কবিতা- নাচে রক্ত নদীর ঢেউ!!


কবি ও নাট্যকার হেলাল জাহাঙ্গীর একজন প্রত্যাশার কবি। দেশের, দশের। কবি নজরুল যেমন সকলের কবি বলে নিজেকে প্রকাশ করেছেন, গঠন শৈলীর পার্থক্য নানাবিধ ভিন্নতা থাকলেও উপমার দৃষ্টান্তে বলবো, কবি হেলাল জাহাঙ্গীর তার কবিতার চরণে চরণে সে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছেন আশার, আলোর। সে প্রত্যাশার পদচিহ্ন কবির কবিত্বকে জাগ্রত করে।


কবিকে বিবেকবান বলা বা না বলা উচিত হবে কি না সে কথার বাইরে কবি নিজের দায় স্বীকার করেছেন তার এ কাব্যগ্রন্থের ‘রক্ত আলোয় ভিজে’ কবিতায়। কবি লিখেছেন, ‘


এখনো অবরুদ্ধতা আছে- লিখে যাই বিবেকের টানে।


বিবেকের কঠিন দাহে যে কবি কাতর, তা তিনি ব্যক্ত করেছে তার কবিতায়। যিনি বিবেকের আলোয় বিপ্লবের কথা বলেছেন। বলেছেন-


 যাঁরা জীবন যুদ্ধে লড়তে পারে- সত্য প্রেমের সৌরভে!!

যাঁরা- বৃত্ত ভেঙ্গে দাঁড়াতে পারে বিবেক আলোর বিপ্লবে!!


কবি চায় শান্তি। কবি শান্তির পায়রা। ‘বুলেটের মুখে থুঃ’ দিয়ে কবি সে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কবি সরল। তরল। কবি ফুলের মতো কোমল। কবি তাই ফুলে দোলায় দোলে, কবিতার সুর বেহালায় নৃত্য করে। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে হেলাল জাহাঙ্গীর কবি হিসেবে নিভৃতে নির্বাসিত।


‘আলোর উপরে আলো’ কবির ২য় কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয় ১ নভেম্বর ২০০৫ সালে। ৩২ পৃষ্ঠার ২৮ টি কবিতা নিয়ে তার এ কাব্যগ্রন্থটি তিনি বিবেকের আলোয় আলোকিত মানুষদের উৎসর্গ করেছেন। যাঁরা সত্য, সত্যকে ধারন করে, সত্য প্রেমের সুবাস নিয়ে দশ দিগন্ত ছড়িয়ে বিপ্লব জারি রাখে। যে বিপ্লবকে কবি ‘শ্রেষ্ঠ কাজ’ বলে উল্লেখ করেছেন তার ‘দিব্য চোখে’ কবিতায়। সে আলোই ‘আলোর উপরে আলো’। সে আলো সর্বোৎকৃষ্ট। সে কারণেই হয়তো কবি বলেছেন, 


শোন যুক্তি, আছে মুক্তি- করো বিপ্লব- ভিতরে-বাহিরে!!


২৮টি কবিতা নিয়ে এ কাব্যগ্রন্থে হয় তো সে কারণেই কবি ‘বিপ্লব’ শব্দটিকে বিভিন্ন আঙ্গিকে ব্যবহার করেছেন মোট ৯ বার। যে বিপ্লব আলো আনে, সর্বোৎকৃষ্ট আলো। আলোর উপরে আলো।


কবি কবিতার ছন্দে নাচে। নাচে হৃদয়ের ছন্দে। কবির কবিতার ছন্দ-গঠন মাপার দুঃসাহস না দেখিয়ে বলবো, কবি অত্যন্ত ছলনাহীন, সরল, সাদামাটাভাবে নিজের কথাগুলোকে প্রকাশ করেছেন তার কবিতার খাতায়। সে বিবেচনায় কবিতাগুলোর উপযুক্ততা নিয়ে আলোচনার অবকাশ থাকলেও কবিতার দর্শন, কবিতার ভাব এবং কবিতার শ্লোগান কবির কবিত্বের পরিচয় বহন করে অনেকাংশে।


‘আলোর উপরে আলো’ কাব্যগ্রন্থটির নামকরণের ব্যাখ্যা দিয়ে কবি যেমন এ কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় লিখেছেন,


 সর্ব উর্দ্ধে প্রভূ সত্য, যথাঃ আলোর উপরে আলো!!


আবার স্রষ্টার অমরত্ব প্রকাশ করে সকল সৃষ্টিকে তুচ্ছ করে একমাত্র স্রষ্টাকে সত্য ও অবিনশ্বর বলে প্রকাশ করেছেন এ কাব্যগ্রন্থের সর্বশেষ কবিতা ‘স্রষ্টাই অবিনশ্বর’ কবিতায়। আবার ‘দেখো-গবেষণা করে’ কবিতায় লিখেছেন- ‘সুন্দরের সর্বোচ্চ ঠিকানা হলো- আলোর উপর আলো!!’ সে দিব্য আলোই কবির চোখে সকল আলোর মাত্রাকে অতিক্রম করে।


পাঠক হিসেবে কবিকে সহজেই ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। কবির মন ও মনন, কবির দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিবার কবিকে নতুনভাবে উন্মোচন করে। জীবনবোধ, জীবনের গান, জীবনের শিল্পকে কবির চেয়ে আর কেইবা সুক্ষ্মভাবে পরখ করতে পারে! কবিতার এ কাব্যগ্রন্থে তিনি এ বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন কিছুটা হলেও।


বৈষম্যের শিকল ছিঁড়ে ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির পথে’ কবি আহ্বান করেছেন তার কবিতায়। ‘মহা সূর্যের তেজে’ ‘সাম্য-শান্তি-মহাসুন্দরের কাজে’ কবি হৃদপিন্ডজুড়ে নতুন সুরের ঝংকারের আভাস পেয়েছেন তাই। ‘সোনার বাংলার সোনা’ কবিতায় কবি এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন -


যেখানে বৈষম্যের কোন দেয়াল থাকবে না/ যেখানে মৌলিক চাহিদার কোন অভাব যে রবে না। 


‘শোষণের বিরুদ্ধে দ্রোহ’ ঘোষণা করে ‘সকল বৈষম্য ও অবিচারের উচ্ছেদের দাবীতে’ ‘জুলফিকার’ কবিতায় কবি অনুরূপ আশা রেখেছেন এভাবে- ‘যে সমাজে থাকবে না বৈষম্য- অন্যায় অবিচার’ সে প্রেরণায় আহ্বান করেছেন- 


সত্যের শক্ত হাতে - হে যৌবন তুলে ধরো- জুলফিকার।


স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ কবি পুঁজিবাদী ও পঁচা সমাজকে ধ্বংস করতে ডাক দিয়েছেন ‘সুষম মানব সমাজ তুলতে হবে গড়ে’। কবি লিখেছেন- 


আর কত দেখবে এ শোষণ তামাশা আর কত?/ জাগো হে গণমানুষ-সর্বহারা-জাগো হে শোষিত।


শোষণের বিরুদ্ধে কবির যে দৃঢ় এবং বলিষ্ঠ অবস্থান তা তার কবিতায় সদম্ভে ফুটে উঠেছে। কবিতায় শ্বাশত সত্যের জয়গান গেয়েছেন, নীতিহীনতার বিপক্ষে টালবাহনার রাজনীতিকে উপহাস ও আক্ষেপ করে তার ‘জ্বলছে সবাই’ কবিতায় লিখেছেন- 


ঐ দেখো- ছলনার ছাই/ যাকে রাজনীতি বলছে সবাই...। 


যে ছলনার রাজনীতিকে ভুলতে কবি ‘দিব্য চোখে’ কবিতায় ‘দুঃখকে বুকে চেপে ইতিহাস পুড়ে...’ যাওয়ার কথা বলেছেন। এবং সে দুঃখে কবিতার জন্মভূমিকে ‘এটা বুঝি মজমা জমানো দেশ’ বলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। এবং ‘আলোর আরশী’ কবিতায় ‘ইতিহাস যত রক্ত চিহ্ন-চোখের জলে মুছে নাও।’ বলে নিজেকে বুঝাতে চেয়েছেন। যেমন ডাক দিয়েছেন দাবি আদায়ের ‘বিশ্বব্যাপী হরতাল’ কবিতায়। লিখেছেন- 


আধিপত্যবাদ এবং মরনাস্ত্র ধ্বংসের দাবিতে,/ বিবেকের ডাকে কাল বিশ্বব্যাপী হরতাল।


কবি জীবনের কথা লিখেছেন, লিখেছেন মানুষের কথা, মানুষ হবার কথা। মুখোশের আড়ালে, পোষাকের আড়ালের মানুষকে কবি উপস্থাপন করেছেন তার কবিতায়। ‘মন-মনুষ্যত্ব বিবর্জিত আচরণ করে’ যেসকল মানুষ, কবির ভাষায় তাঁরা ‘মানুষরূপী পশু’। তাদের উদ্দেশ্যে কবিতার ‘লজ্জা’ কবিতায় লিখেছেন- 


হে মানুষ! তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত এজন্য যে,/ নিজেকেই আজো তুমি পূর্ণভাবে- চেনোনি যে নিজে!!


যেমন লালন বলেছেন, অপরকে চিনতে হলে নিজেকে চিনতে হবে, নিজেকে চিনলে সকলে চেনা যাবে। আবার ‘আড়াল’ কবিতায় কবি তাই লিখেছেন-


মনে রেখো- পৃথিবীতে মানুষ হওয়া- সবচেয়ে সুকঠিন!!


তাই কবি মুক্তির জন্য ‘ভিতরে বাহিরে’ বিপ্লবের কথা বলেছেন তার ‘এলো বৈশাখ’ কবিতায়। বলেছেন-


মন্দের সাথে নিরবে-সরবে অবিরত .. যুদ্ধ করার কথা

 

তার ‘আমার যে যৌবন’ কবিতায়।

 

কবি মনের পুজারী। হেলাল জাহাঙ্গীর তার ‘মনের ঘর-বাড়ি’ ও ‘মনের মানুষ’ কবিতায় তার সাক্ষ্য রেখেছেন। কবি লিখেছেন- ‘মনের মধ্যেই ঘটে- প্রেম ও সৌন্দর্য্যের প্রকাশ!’ আবার ‘আলোর পৃথিবী’ কবিতায় লিখেছেন ‘প্রেমই মূল ধর্ম।’ শিমুল মুস্তফা যেমন বলেছেন- “প্রেম আমার জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।” সুতরাং কবিতার হৃদয়ের সুর উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই কবি ‘সত্য প্রেমে সেজে’ ‘লুন্ঠিত অধিকার’ কেড়ে নেবার কথা লিখেছেন। 


কবিমন রূপলাবণ্যের কাছে হেরে যায়। কেননা কবি সুন্দরের সেবক, সত্যের বাহক।

 শীতের কুয়াশা দিয়ে - প্রেমিকার চোখের তারায়/ বসন্তের বিপ্লবী রঙে - দাসত্বের মুক্তির শপথে

কবি মনোনিবেশ করেছেন সে কারণে। ‘বর্ষা শুভেচ্ছা’ কবিতায় ‘হরেক রকম বাণীর সৃষ্টি’ হবার কথাও বলেছেন কবি। প্রেম যেখানে বিরহ সেখানে অবধারিত। কবিতার ‘মনের মানুষ’ কবিতায় তাই লিখেছেন, 


মনের মানুষ যায় যদি হে দূরে, / দূর হয়ে যায় বহুবহু দূর!/ মনের মানুষ রাগলে অন্তঃপুরে,/ সুর হয়ে যায় হঠাৎ যে বেসুর!!


যে আলো নিভে যায় নিমিষেই। মনকে বিষিয়ে অন্ধকারে ঢেকে। কবিব্যক্ত সে কথা এভাবে- 


জোৎস্না হঠাৎ আঁধারে যায় ঢেকে।


প্রেম, সাম্য ও স্বাধীনতার জন্য কবিআত্মার আর্তচিৎকার ও নিপুণ কৌশলের সমন্বয় ঘটেছে তার এ কাব্যগ্রন্থে। বিপ্লবের সে সুপথের সন্ধানে কবি তাই লিখেছেন- সে চোখের ঢাকনা খোল- মনের গভীরে যে চোখ। যে চোখে মুক্তির আলো আনে। দীপ্ত হয়- ‘আলোর উপরে আলো।’


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?