কবি ও নাট্যকার হেলাল জাহাঙ্গীর রচিত ‘অন্তর অতলে জ্বলে জীবন্ত স্বরূপ’ কাব্যগ্রন্থটিতে কবির বাস্তব জীবনবোধ, সামাজিক অসংগতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রেম, আধ্যাত্মিকতা, ভাষা আন্দোলন এবং আমাদের মহান স্বাধীনতার কথা জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
ধরলা, তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদ-নদীবেষ্টিত অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জেলা কুড়িগ্রামের মানুষের অভাব ও জীবনবোধের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তার কবিতার প্রতিটি পঙক্তির মধ্যে, কুড়িগ্রামের মতো অবহেলিত জেলার মানুষ হয়েও তিনি তাঁর কবিতার ভাষা ও নির্মানশৈলী দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন সাহিত্যে সুউচ্চ শাখায়।
২০১২ সালের একুশে বইমেলায় ‘অন্তর অতলে জ্বলে জীবন্ত স্বরূপ’ কবিতা গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ করেছে ঝিঙেফুল প্রকাশনী। বইটিতে লেখকের চমৎকার উৎসর্গপত্রে কাব্যময়তা বইটির নান্দনিকতাকে অসামান্য করে তুলেছে। গ্রন্থটিতে মোট কবিতা সংখ্যা ৫১টি। অনিন্দ্য রেজার প্রচ্ছদে হাত প্রসারিত করে উর্ধ্ব দিকে বাহু প্রসারিত করে জীবন্ত স্বরূপ চিত্রায়ণ বইটির নামকরণের সাথে প্রচ্ছদের মিলনের যথার্থ সার্থকতা প্রকাশ করে।
গ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘প্রেম শক্তি’। প্রেম শক্তি কবিতায় কবি যাহা কিছু পৃথিবীতে পবিত্র ও মানব কল্যাণকর, যাহা চির ক্ষমতাধর, যে শক্তি মানবমুক্তির বার্তাবাহক এবং আধারের ক্ষয় করে আলোর পথ দেখায়। সকল অশুভকে বিনাশ করে তার নাম দিয়েছেন প্রেম। কবির ভাষায়-
যে শক্তি বিজ্ঞানময় ও সৌন্দর্যময়; তার নাম প্রেম
যে শক্তি স্নেহময় এবং চির শক্তিময়; তার নাম প্রেম।
এভাবেই কবি প্রেম শক্তি দিয়ে সকল খারাপ শক্তিকে দূর করে মানব মুক্তির স্বপ্নে যখন বিভোর তখন হঠাৎ করেই দ্বিতীয় কবিতায় কবি হরতালের ডাক দিলেন।
সাধারণত আমাদের দেশে হরতাল মানে জ্বালাও, পোড়াও... দূর্ভোগ। কিন্তু কবি তার ‘বিশ্বব্যাপী হরতাল’ কবিতায় বিশ্বময় শান্তির জন্য, এ পৃথিবীর সকল প্রাণিকুলের শান্তির জন্য, সকল বৈষম্য ও অবিচারের উচ্ছেদের দাবিতে হরতাল ডাকলেন। যে হরতাল মানুষের কল্যাণে, আধিপত্যবাদ ও মরনাস্ত্র ধংশের দাবিতে। কবি তাঁর প্রেয়সীকে উদ্দেশ্য করে কবিতার ভাষায় বলেছেন-
সঞ্চিতা শোন, আজ কবিতা পাঠ হবে বাংলাতে
পৃথিবী থেকে সকল অসাম্য ও অপ্রেম পোড়াতে।
কবি তাঁর কবিতায় পৃথিবী থেকে অপ্রেম পোড়াতে চেয়েছেন, প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন বিশ্বময় শান্তি। আর তাই তিনি ডাক দিয়েছেন বিশ্বময় হরতালের। ‘বিশ্বময় হরতাল’ কবিতাটি যখন পড়ছি তখন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তরুণ নাগরিক কবি সৈকত আমিনের ‘গোরখোদকের গান’ কাব্যগ্রন্থের পংক্তি-
আমি স্বপ্ন দেখি কুচকাওয়াজের শব্দে শিশুদের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় সেনাবাহিনী আয়োজন করেছে গণক্ষমার।
যেখানে ক্ষমতাধরদের খেয়ালখুশিমত সব কাজ হচ্ছে, কোন জবাবদিহিতা নাই সেখানে একজন কবি স্বপ্ন দেখছেন সেনাবাহিনী গণক্ষমার আয়োজন করেছে। হয়তো নাগরিক কবি হিসেবে সৈকত আমিনের পক্ষে সেই স্বপ্ন দেখাটা শোভনীয় কিন্তু আটপৌরে অভাবী জীবনযাত্রায় বেড়ে উঠা কুড়িগ্রামের কবি হেলাল জাহাঙ্গীর কীভাবে স্বপ্ন দেখেন বিশ্বময় হরতালের! এখানেই কবির স্বার্থকতা। কবি কোন নির্দিষ্ট সমাজ কাঠামো, নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের বাসিন্দা নন। তিনি বিশ্বময় চিন্তা করতে পারেন। এবং হেলাল জাহাঙ্গীর তা করে দেখিয়েছেন।
এরকম একটি আনন্দ মূর্ছনা প্রাণবন্ত কবিতা শেষ করে পাতা উল্টাতেই কবির আমি ও তুমি ঘরানার কবিতার দেখা পাই। যেমন- স্বরূপ শিখা, তুমিই অতঃপর সব আরো কিছু কবিতা যা কবির আবেগ প্রসূত, বিদগ্ধ যৌবনে কোন প্রেয়সীকে কল্পনা করে লেখা। যা সম্ভবত কবির যৌবনের প্রথম দিককার লেখা। কবিতাগুলো পড়ছি আর পূর্বের কবিতার ভাব, ভাষা ও মাধুর্য নিয়ে ভাবছি। কবি কি এই কাব্যগ্রন্থে তাঁর জীবনের বিভিন্ন সময়ের কাব্যগুলোর সংকলন করেছেন না কী তিনি কাব্যগ্রন্থটিকে স্বাস্থ্যবান করতে এই কবিতাগুলো এখানে সংযুক্ত করেছেন। সেরকমই আরো একটি কবিতা ‘যোগ’। কবি কিছু রাসায়নিক বিক্রিয়ার মুখস্ত পাঠের পুনরাবৃত্তির সাথে প্রেমের বিক্রিয়া ঘটিয়ে নতুন কিছু বলবার চেষ্টা করেছেন।
‘ঢোল বাজছে’, ‘ওম শান্তি’, ‘ধ্রুব স্মৃতি’, ‘পবিত্র বিষ্ময়’ নামক কবিতা দিয়ে গ্রন্থটিকে যৌবনাবতী করে মোটাতাজা করবার পর হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। এবার তিনি রচনা করলেন তার কবিতা ‘ঘুমিও না’।
এ কবিতায় কবি সমকালিক বিচার ব্যবস্থা, লুটতরাজ ও দেহতাত্ত্বিক চিকিৎসাপত্র দিয়েছেন একজন সাধকগুরুর মতোই। তিনি তার কবিতায় পরামর্শ দিয়েছেন নাকে তেল দিয়ে না ঘুমিয়ে বরং লেখ, পড়। এতে জীবনে সফলতা আসবে। এখানে দার্শনিক লিও টলস্টয়ের কথা মনে পড়ে যায়, তিনিও বলেছিলেন- “জীবনের জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন, বই বই আর বই।” পরক্ষণে কবি ধ্যানী হয়ে উঠলেন, দিলেন দেহত্বত্ত্বের বর্ণনা। কবি তার ‘মানব গাড়ি’ কবিতায় বললেন-
মানব গাড়ি সাবধানে চলো,
নয়তো দুনিয়াদারি হতে সব চিন মিশে যাবে।
প্রতিটি মানুষই জীবনের কোন না কোন সময়ে এসে জীবন মৃত্যু ঈশ্বরবাদ নিয়ে ভাবতে থাকেন। ইহজাগতিক চিন্তা চেতনা ছেড়ে উদাসীন হয়ে যান। কবি হেলাল জাহাঙ্গীর একজন মানুষ হিসাবে মনুষ্য ধারার বাইরে যেতে পারেননি। তিনি তার ‘কর্মফল’ কবিতায় যেন মৃত্যু পরবর্তী জীবন দর্শন করেছেন। কবির বর্ণনায়- এই পৃথিবীতে আমরা ক্ষণস্থায়ী প্রাণ নিয়ে এসেছি। তাই আমাদের এখানে আত্মশুদ্ধি হয়ে যেতে হবে। পরকালের জীবন হলো অনন্ত জীবন। এখানে লাজ লজ্জার কিছুই নেই। আমাদের ইহজীবনের কর্মফল পরজনমে ভোগ করতে হবে।
‘অন্তর অতলে জ্বলে জীবন্ত স্বরূপ’ নাম কবিতায় কবি যেন আরো বেশি প্রভূমুখো হলেন, তিনি তার হৃদয় ঘরে প্রভুর উপস্থিতির কথা স্মরণ করে লিখেছেন-
যখন হৃদ আকাশে
তোমার রূপের আলো হাসে
পোড়ে মনের ধূপ
অন্তর অতলে জ্বলে জীবন্ত স্বরূপ।
‘অস্ত্র নামাও দাঙ্গা থামাও’ কবিতায় কবি ধর্মভিত্তিক দাঙ্গা এবং মানুষে মানুষে যে বিভেদ তা নির্মুলের আহবান করেছেন। কবি জোর দিয়ে বলেছেন, কোন ধর্মে শান্তির নামে দাঙ্গার কথা নাই, দাঙ্গা হাঙ্গামা কখনো শান্তি আনতে পারে না। বরং বিধাতা খুশি হন জীবে প্রেম করলে। ধর্মের নামে অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করা বন্ধ করতে কবি আহবান জানান।
কবি যেন সমকালীন সময়ের পাতানো খেলার ছন্দে কবিতামালা দিয়ে কাব্যগ্রন্থটি সাজিয়েছেন। এই একটি কবিতা আমি ও তুমি ধারার, আবার পরক্ষণে আধ্যাত্মিকতা। কিংবা পাতা ভারি করার জন্য কাঁচা হাতের কিছু কবিতা। সেরকমই ‘তিন ভাগ’ কবিতায় কবি তথ্যগত কিছু বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কবিতাটি শেষ করেছেন কুমিরের খাঁজকাটা গল্পের মতো মেলানো মেশানো পাতানো খেলার ঢঙ।
ব্রিটিশ পরবর্তী যে সকল কবি বাংলা সাহিত্যে এসেছেন তাদের প্রায়ই সকলেই একটি কাজ করেছেন তা হলো স্বদেশ, স্বাধীনতা এবং একুশ নিয়ে কবিতা রচনা। সম্ভবত এসব নিয়ে কবিতা না রচনা করলে কবিতা চর্চায় ঘাটতি থেকে যায়। না কী পদক প্রাপ্তিতে নমিনেশন পাওয়ার সম্ভাবনায় ভরাডুবি ঘটে আমার বোধগম্য নয়। যাইহোক, কবি হেলাল জাহাঙ্গীর সম্ভবত তার নমিনেশন হারানোর ভয়ে নয় বরং দার্শনিক হেগেলের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই লিখেছেন। যে দেশে গুণীর কদর হয় না, সে দেশে গুণী জন্মান না। গুণীর জন্মানো চলমান রাখতে তিনি লিখলেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন স্মৃতিপট নিয়ে কবিতা ‘রক্তিম অন্তর’।
‘রক্তে লেখা সবুজ ইতিহাস’ কবিতায় কবি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। কবিতাটি পড়ে মনে হলো কবি এখানে শুধু শ্রোতে গা ভাসিয়ে দিলেন। সকলের যেমন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা থাকে, আমার কেন থাকবে না! এবং তিনি প্রসব করলেন। তিন পৃষ্ঠার কবিতাটিতে তিনি লিখলেন একজন মানুষের মহত্বকথা, গুণকীর্তন আর বাকীটা ইতিহাস।
এছাড়াও কবি ‘অন্তর অতলে জ্বলে জীবন্ত স্বরূপ’ কাব্যগ্রন্থে কিছু কবিতা রচনা করেছেন যা অন্যকোন সময়ে অন্যকোন কবির কবিতার অনুসরণ বলে মনে হয়। সেরকম একটি ‘তোমাকে পেয়েছি বলে হে স্বাধীনতা!’ কবিতাটি শামসুর রাহমানের ‘তোমার জন্য হে স্বাধীনতা’ কবিতার অনুসরণে রচিত বলে প্রতীয়মান হয়। পার্থক্য শুধু শামসুর রাহমান স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করেছেন, আর আমাদের কাব্যকার স্বাধীনতার পরের প্রাপ্তির কথা চিত্রিত করেছেন। আদতে বিষয়টির মধ্যে মিল পাওয়া যায় ঢের।
‘আজব দেশ’ কবিতায় কবি এদেশের রাজনৈতিক শোষণ ও মানুষের বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়েও শেষে খাঁজকাটা কুমিরের গল্পের আদলে শেষ করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই কবি ছন্দে ফিরে এলেন। আবারো রানের খাতা খুললেন তার ‘জ্বলে ওঠো’ কবিতায়। শোষিত বঞ্চনার বিদ্রোহগাথা এই কবিতায় কবি স্বাধীনতা বলতে অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি না বুঝিয়ে বরং ভাত কাপড়ের নিশ্চয়তার স্বাধীনতার কথা বলেছেন। কবির ভাষায়-
ভাষার মুক্তি এসেছে বটে
এসেছে স্বাধীনতা
আসেনি কিন্তু আসল মুক্তি
বাঁচার নিশ্চয়তা।
‘শান্তির পতাকা’ কবিতায় কবি শোষণের বাতিল বিধান পুড়ে, আঁধার বৃত্ত ভেঙ্গে সাম্যের আলো জ্বালাতে চান। মন্দের সাথে যুদ্ধ করে পৃথিবীকে শুদ্ধ করবার স্বপ্ন দেখেন। কবি সারা জগতময় শান্তির একই পতাকা উত্তোলন করতে চান।
বহুমাত্রিক চিন্তাধারার কবি হেলাল জাহাঙ্গীর তার এই কাব্যগ্রন্থে সকল বিষয়ের উপর একটু আলতো ছোঁয়া রাখবার চেষ্টা করেছেন। যা পাঠকমাত্রই ভালো লাগবে। ৫১টি কবিতা নিয়ে ৬৪ পৃষ্টার বইটির বাজার মূল্য ৮০ টাকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?