সাহিত্য হচ্ছে সংস্কৃতি-কৃষ্টির ধারক বাহক। সেই অর্থে একটি দেশ জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সাহিত্যের অবয়বে লালিত হয়, পরিষ্ফুটিত হয়, বিকশিত হয়। সাহিত্য ব্যতীত দেশ ও জাতির অস্তিত্ব শূন্য গর্ভের মতই।
তাই এর চর্চা ও লালনে সকলকেই এগিয়ে আসা উচিত। “সভ্যতা বিনির্মাণেও সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য।”
সাহিত্যে যেমন আত্ম-উপলব্দির বিকাশ ঘটে, দেশ জাতির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠে তেমনি তা নতুন প্রজন্মের নিকট এক অনুকরণীয় অধ্যায়রূপে বিবেচিত হয়।
সাহিত্য চর্চায় কুড়িগ্রাম জেলার বিশাল ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অনেক যুগান্তকারী লেখক কুড়িগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক, নাট্যকার গোলাম সারোয়ার ও আব্দুল হাই সিকদার উচ্চ মর্যাদায় আসীন। তাঁরা তিন’জনেই তাঁদের জন্মস্থানের ঠিকানা কুড়িগ্রাম বলে গর্ববোধ করেন। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক সম্প্রতি ইহলোক ত্যাগ করেও কুড়িগ্রামকে করে গেছেন সমৃদ্ধ।
রংপুর সদর এলাকা ও কুড়িগ্রাম এলাকার লোকদের মুখের ভাষা ও কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে কোন তফাৎ নেই। চর্যাপদের ভাষা ও নাথ সাহিত্যের ভাষা থেকেও এসত্য ইতিমধ্যে পন্ডিতগণ প্রমাণ করেছেন। পন্ডিতগণ এও দাবী করেছেন যে চর্যাপদের ভাষা বহুলাংশে রংপুর-কুড়িগ্রামের ভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ভাওয়াইয়া পল্লীগীতি বাংলা সংস্কৃতির একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। ভাওয়াইয়া পল্লীগীতির কিংবদন্তী শিল্পী আব্বাস উদ্দিন কুড়িগ্রামের উত্তর প্রান্তের থানা শহর ভূরুঙ্গামারীর সীমান্তবর্তী তোরশা নদীর পাড়ের মানুষ। এক সময় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী সড়ক ছিল তার বিচরণ পথ। কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাই ছিল তার গানের ভাষা। আব্বাস উদ্দিন কুড়িগ্রামের গৌরব ছিলেন। বৃহত্তর রংপুরেরও গৌরব, বাংলাদেশের গৌরব, বাঙালী জাতির গৌরব। ‘কুড়িগ্রাম জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।
সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’ ও ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকদ্বয় বাংলাদেশের সব জেলা শহরে ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন জেলাসহ কলকাতাতেও সাড়া জাগিয়েছে। এই নাটক দুটি সমকালীন শ্রেষ্ঠ নাটকের স্বীকৃতিধন্য হয়েছে, সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় বাঙালীর গৌরবকে আরো একবার সমুন্নত করেছে। এ দুটি নাটকের ইংরেজি সংস্করণ বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। সৈয়দ হকের অন্যান্য কবিতার ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর নাটক ও কবিতা বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে রয়েছে। দেশবরেণ্য এ লেখকের অনেক কাব্যগ্রন্থ, গল্প, নাটক, উপন্যাস জনপ্রিয় হয়েছে পাঠকদের কাছে। তার লেখা সংগীত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ গৌরব সবার, এ গৌরব কুড়িগ্রামের, রংপুরের, বাংলাদেশের। এ গৌরব সকল সাহিত্য গবেষকদের।
ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক প্রয়াত তপন কুমার রুদ্রের কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতায় শ্রেনীঘাত’ ও ‘মাকে বলা আমার কিছু মিথ্যে কথা’ প্রবন্ধ 'প্রাক-পরিচয়' এবং উপন্যাস ‘অংশী’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার অনেক কবিতা-প্রবন্ধ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রপত্রিকার পাশাপাশি বিভিন্ন সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে যা জাতীয় মানের। মোস্তফা তোফায়েল হোসেন এর ‘কুড়িগ্রাম ও রংপুর জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থ প্রকাশের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও তার ইংরেজি-বাংলা দ্বিভাষীক কাব্য ঢাকা বই মেলায় ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে। কুড়িগ্রামের সাহিত্যকদের মধ্যে যার নাম বার বার ফিরে আসে তিনি প্রয়াত শিক্ষক আব্দুল হামিদ। যার অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক স্থানীয় সাহিত্যপত্রিকা সহ জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। যার মাধ্যমে অনেক সাহিত্যকর্মীর সৃষ্টি হয়েছে এই কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামের একজন প্রবীণ আইনজীবি সরকার আব্দুল করিম শৈশব থেকেই এখন পর্যন্ত নিরবেই নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছেন। তার কোন বই প্রকাশিত না হলেও তার অসংখ্য কবিতা গল্প সাহিত্যপত্রিকা সহ স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে।
সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক একাধারে নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিক। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে ‘প্রাণহীন প্রতিকৃতি’, নির্বাচিত গল্প ও প্রবন্ধের বই ‘আত্মদার্শনিক প্রেক্ষিতে কবিতার অবস্থান’।
সাংবাদিক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনের প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘বাসন্তী কথা’, প্রবন্ধ ‘অপরাজনীতি ও অন্যান্য’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ ও নিবন্ধ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা ও সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশ হয়।
নূর উন নবী বাবুর লেখা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন দৈনিক ও ম্যাগাজিনে দেখা যায়, তার প্রবন্ধের বই ‘বঙ্গবন্ধুর কর্মযজ্ঞ ও দ্বিতীয় বিপ্লব’ প্রকাশিত হয়েছে।
সাংবাদিক মমিনুল ইসলাম মঞ্জু শক্তিমান সাহিত্যকর্মী, তাঁর বেশকিছু প্রবন্ধ বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য সাময়িকীসহ স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকার প্রকাশিত হয়েছে।
প্রতিভাবান লেখক, আলোচক, উপস্থাপক চঞ্চল বোসের প্রবন্ধ বিভিন্ন গবেষণা পত্রিকায় বেরিয়েছে। এছাড়াও তার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছে।
কবি মিজান খন্দকারের কাব্যগ্রন্থ ‘যথাকবি নিরঞ্জন’, ‘জন্মান্তরিত হবো কোন নব গৃহে’, গল্প ‘পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ’ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার অসংখ্য কবিতা প্রথম আলো, ভোরের কাগজ, জনকণ্ঠ সহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রায়ই দেখা যায়।
হেলাল জাহাঙ্গীর নাটক রচনা করে ইতিমধ্যেই নাট্যকার হিসেবে বেশ খ্যাতি পেয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য নাটক গুলো হচ্ছে ‘মহানন্দা’, ‘উত্তরে অগ্নিকাল’, ‘বিপ্লব বক্ষে স্বদেশ’। এছাড়াও তার দুটি কবিতার বই ‘আলোর উপরে আলো’, ‘জ্বলে প্রেম! জ্বলে আজন্ম বিপ্লব!!’ প্রকাশিত হয়েছে।
আব্রাহাম লিংকন এর কবিতার বই ‘শেষ যুদ্ধের ডাক দিয়ে যাই’, ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস’, ‘মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস রংপুর’ সহ বাংলা একাডেমির ‘বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস’ চতুর্থ খন্ডে তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও তার লেখা নিয়মিত জাতীয় দৈনিকে দেখা যায়।
কবি জ্যোতি আহমদ, ইমতে আহসান শিলু, সোলায়মান বাবুল, জামাল অন্তর, জুলকারনাইন স্বপন, মাইকেল রবিন সরকার, আশিষ বকসী, আলমগীর কবির, লাইলি বেগম প্রমুখ এর কবিতা নিয়মিত বিভিন্ন সংকলন ও ছোট কাগজে প্রকাশিত হয়েছে, এঁদের কবিতা বই আকারে প্রকাশ করার যোগ্যতাসম্পন্ন। কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এঁরা ইতিমধ্যে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে।
প্রয়াত লেখক হোসনে আরা পারুলের বেশ কিছু কবিতা উপন্যাস ও গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে।
সাংবাদিক আব্দুল খালেক ফারুক’র গল্পগ্রন্থ ‘কাঁটাতারে ঝুলে আছে ফেলানী’, নাটক ‘গোলামের দরবার’ ও উপন্যাস ‘সন্দেহভাজন’ প্রকাশিত হয়েছে।
জুলকারনাইন স্বপন এর গল্পগ্রস্থ ‘অতলে জীবন’, ইউসুফ আলমগীরে’র কবিতার বই ‘চক্করে চক্করে ওড়ে বাউরি বাতাস’, মাইকেল রবিন সরকার সম্পাদিত কবিতার বই ‘কিছু মেঘ ছায়ার শরীর’, মাহফুজুর রহমান লিংকন’র কবিতার বই ‘অমীমাংসিত ফুলের দেবতা’, সজল সমুদ্রে’র কবিতার বই ‘পত্রে রচিত ভোর’ ও ‘ডালিম যেভাবে ফোঁটে’, মাহবুব অনিন্দ্য’র কবিতার বই ‘অপার কলিংবেল’, সাম্য রাইয়ান এর প্রবন্ধের বই ‘সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট', কবিতার বই ‘বিগত রাইফেলের প্রতি সমবেদনা’, ‘মার্কস যদি জানতেন’, রাশেদুন্নবী সবুজের কবিতার বই ‘অ্যা ড্যান্স নাইট জার্নাল’, উত্তম চৌধুরীর উপন্যাস ‘উমা অন্তর দহনে’, বাদশা সৈকত’র গল্পগ্রন্থ ‘জীবনের ছায়াপথ’, উপন্যাস ‘পলায়ন’, ‘তোমার জন্য লেখা’ কাব্য গ্রন্থ, ‘সর্ম্পকের দেয়াল’ সহ বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলার সহকারী অধ্যাপক সুশান্ত বর্মন প্রবন্ধ ও শিশুতোষ গল্প রচনায় যথেষ্ট পরিচিতি পেয়েছেন।
নবীনদের মধ্যে আতিকুর রহমান মিলু ‘শাব্দিক’ নামে একটি ছোট পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করছেন। এছাড়াও আকরাম হোসেন, জাহানুর রহমান খোকন সহ বেশ কিছু নতুন ছেলে সাহিত্য চর্চায় অবদান রাখতে শুরু করেছে।
মনোরঞ্জন বর্মন উলিপুর থেকে একাধারে প্রাবন্ধিক, সমালোচক এবং ইতিহাস লেখক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। কাফী বীর ও সাংবাদিক পরিমল মজুমদার শক্তিমান সাহিত্যকর্মী। ‘চিলমারীর ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক নাজমুল হুদা পারভেজ সম্ভাবনাময় লেখক। নাগেশ্বরীর কাদের, রেজাউল করিম রেজা, মেধাবী সাহিত্যের কর্মী। শ্বাশত ভট্টাচার্য গবেষক ও প্রাবন্ধিক। তিনি ‘রংপুর জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থে রংপুর জেলার ‘মেলা’ বিষয়ের প্রবন্ধকার, আলোচক। কুড়িগ্রামের সংস্কৃতি জগতের প্রায় অনুচ্চারিত দুটি নাম শামসুল ইসলাম মন্ডল ও দেবব্রত বকশী। প্রথমজন আলোচক, দ্বিতীয় জন বেতার ও মঞ্চ নাট্যকার, অভিনেতা ও গায়ক।
প্রিয় পাঠক এ লেখায় কুড়িগ্রামের সাহিত্যকর্মীদের সকল বিবরণ রয়েছে বলে আমি দাবী করি না। তবে আগামীতে কুড়িগ্রামের সাহিত্য চর্চার ইতিবৃত্ত রচনা করতে লেখাটি সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করতেই পারি।
* শ্যামল ভৌমিক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী
--------০--------
সূত্র: কুড়িগ্রাম জেলার সাহিত্য চর্চার ইতিহাস সম্পর্কিত হওয়ায় কবি মিজান খন্দকার সম্পাদিত 'জলগৃহ' পত্রিকা থেকে রচনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে। লিংক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?