মাকে বলা মিথ্যে কথা এবং কবিতায় শ্রেণীঘাতের কবি তপন কুমার রুদ্র। পেশায় অধ্যাপক ছিলেন। জল ঈশ্বরের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ঢেউয়ের দ্বন্দ্বমুখর তরঙ্গে দিয়েছেন প্রাক পরিচয় যেনো। যার জ্ঞান রয়েছে ঋদ্ধ উপলদ্ধির স্খলন ঘটেছে যাঁর লেখায়।
"প্রাক - পরিচয়" মূলত প্রবন্ধ গ্রন্থ। ভাষা, বাংলা- বাঙালি, সাহিত্য ও সংষ্কৃতিই মুল উপজীব্য। ভিত্তি মুলে স্পর্শ করে আছে জাতিসত্তার চিহ্নিত বলিরেখা। আদ্যোপান্ত ঘুরে এসে বাঙালি হয়ে কথা বলেছেন স্পষ্ট। সমাজ, রাজনীতি ও সাহিত্যের রসদ যোগ করে গড়েছেন লেখনীর পাহাড়। যার মর্মমূলে মানবতার জয়গান। সাজিয়েছেন যেনোবা রুচিশীল রাষ্ট্র। অগ্রসর হলে আবার ফিরে আসার তাগিদ নেই ভেবে হেঁটেছেন বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনে।
ভাষার রাজনীতির ইতিহাস আমাদের বহু পূর্বের। "অত্যাচারীর কালো হাত, ভেঙ্গে দাও / গুঁড়িয়ে দাও " এই শ্লোগান ছিলো বৃটিশদের শাসনামলে বৃটিশবিরোধী বাঙালিদের। তাদের অত্যাচার আর নিপীড়নে অতিষ্ট ছিলো বাঙালি। অথচ কালো হাত বাঙালিদেরই ছিলো। তাহলে এর মানে দাঁড়ায়, বাঙালিদের কালো হাত ভেঙ্গে দাও। এভাবে ভাষার রাজনীতির চর্চা চলে আসতেছিলো।
পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালিদের ভাষার উপর আঘাত হানার ইতিহাস আমরা আজও গেয়ে যাই ভাই হারানো একুশের গান। যা ভুলবার নয়। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও মুক্তিযুদ্ধের গতিবিধি নিয়ে রচনা করেন তার প্রবন্ধ।
যা হোক। তপন রুদ্র কবিতায় চেনা হলেও তার গদ্য ছিলো দর্শন নির্ভর। যুক্তির আলোকে দেখিয়েছেন ভাষা, সাহিত্য ও সংষ্কৃতির মিলবন্ধন। তাঁর এ বিশ্লেষণাত্মক লেখনী পাঠকের দৃষ্টিগোচর না হয়ে উপায় নেই।
বিশটি প্রবন্ধ ফুলে সাজানো প্রাক পরিচয়ের বাগান। যার ছত্রে ছত্রে বাঙালির স্মৃতি, রীতি ও দূর্নীতি। স্বাধীনতা, ভাষা ও ভাষা আন্দোলন। বাঙালি কবি, কবিতা ও ছোটগল্প। ইংরেজি কবি ও কবিতা। শিক্ষা, বিজ্ঞান - প্রযুক্তি ও যুদ্ধ।
গ্রন্থকারের জীবিত সময়ের বাঙালি কবিদের রুচি, দূর্নীতি ও তার নৈপথ্যে বিচার নিয়ে তার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে লেখায়। রেখাপাত ঘটেছে রবীন্দ্র কাব্য ও আধুনিকতা, বিশ্ব রাজনীতির হালচাল।
সব অতীত গৌরবের নয়। অতীতে যা ঘটে যায় যখন তা বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি রূপকথার মতো হয়ে যায়। সেটা যতোই অলীক ও অসম্ভব হোক। প্রাক -পরিচয়ের প্রথম প্রবন্ধে লেখক তারই ইঙ্গিত দেন। আদিকাল থেকে মানুষের ইতিহাসে ঋতু ভিত্তিক বন্দনার প্রমাণ মেলে। বর্ষাও তার ব্যতিক্রম নয়, বাঙালীদের কাছে। যেমন বসন্তে "ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত"। লেখকের এই বন্দনারত সময়ের আবর্তন দৃষ্টি এড়ায় না।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের কবি সত্ত্বা নিয়ে লিখেছেন, বাঙালি কবিদের একটা বড় ইতিহাস রয়েছে, যা তাদের ভুলার মতো নয়।
সমালোচনা করার একটা বিষয়ই চোখে পড়ার মতো, বানান। লেখক এ জায়গায় উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন।
শ্রেণি সংগ্রাম সমাজের কাঠামো কিংবা উপরি কাঠামো দ্বন্দ্ব মানসিকতায় তাঁর লেখায় জায়গা করে নিয়েছে বারবার। কুড়িগ্রাম ছোট শহরে বসে তাঁর এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ যেভাবে পেয়েছে। যার ব্যাখ্যা হয় না আসলে। তাঁর এই নিভৃতচারী পথচলা আমাদের পাথেয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?