স্মৃতিতে প্রিয় তপন স্যার | প্রফেসর মীর্জা মো: নাসির উদ্দিন

স্মৃতিতে প্রিয় তপন স্যার | প্রফেসর মীর্জা মো: নাসির উদ্দিন

১৯৮২ সালে এসএসসি পাস করার পর কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হই। কুড়িগ্রাম সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের সাথে আগে থেকেই পরিচয়। কিন্তু শিক্ষকদের সাথে আমার তেমন কোন পরিচয় ছিল না। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম একাদশ শ্রেণীর ক্লাস করবার জন্য বিশেষ করে কলেজের প্রথম ক্লাস করার জন্য। আমাদের কলেজের প্রথম ক্লাস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর। প্রথম ক্লাস কলেজের ০৩ (বর্তমান নম্বর -১১০৬) নম্বর কক্ষে সকাল ৯.০০ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেকটি ক্লাসই ছিল উপভোগ্য এবং স্যারদের  সুন্দর সুন্দর জ্ঞানসমৃদ্ধ বক্তব্য আমাদের সকল শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করে এবং আমাদের চিন্তায় পরিচ্ছন্নতা দান করে। তৃতীয় ক্লাস সকাল ১১.৩০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় ক্লাস ছিল ইংরেজি বিষয়ের ওপর। পরিশীলিত পোশাকে চশমা পরিহিত সুদর্শন এক স্যার ক্লাসে প্রবেশ করলেন। তিনি ক্লাসে প্রবেশ করেই আমাদের সকলকে বসতে বললেন। স্যার পরিচয়ে বললেন আমি তপন কুমার রুদ্র, কুড়িগ্রামের মানুষ এবং কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজেরই একজন প্রাক্তন ছাত্র। স্যার এটুকু বক্তব্য শুধুমাত্র বাংলা বললেন এরপর ৪৫ মিনিটের ক্লাসে আর কোন বাংলা বলেননি। অত্যন্ত সুন্দরভাবে ইংরেজিতে প্রেরণামূলক  বক্তব্য প্রদান করেন। প্রথমদিকে স্যারের বক্তব্য বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছিল কিন্তু সাবলীল উচ্চারণ এবং সুন্দরভাবে উপস্থাপনার কারণে স্যারের  বক্তব্য পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হই। মধ্যম সারির মেধার ছাত্র হলেও ছোটবেলা থেকে ইংরেজির প্রতি আমার আকর্ষণ ছিল সবসময়। আমার কৃষক পিতা সবসময় আমাকে উদ্বুদ্ধ করতেন ভালভাবে ইংরেজি শিখতে। তিনি সবসময় বলতেন হুজুর যদি আরবী বলতে না পারে তাঁকে কেউ মৌলভী আর শিক্ষিত মানুষ যদি ইংরেজি বলতে না পারে তাহলে তাঁকেও কেউ শিক্ষিত বলবেনা। পিতার ইচ্ছা অনুযায়ী আমারও একটি স্বপ্ন ছিল সুন্দরভাবে ইংরেজি বলা। কিন্তু  সেসময় আমার জানামতে যাঁরা ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে গর্ব করতেন তাঁর শুধুমাত্র ভাঙ্গা ইংরেজি বলতেন। কখনও দেখিনি পুরো ২টি বাক্য একসঙ্গে বলতে। তপন স্যারের ক্লাস করার পর আমার সেই ধারণা সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেল। স্যারের বক্তব্যে উজ্জীবিত হয়ে সংকল্প করলাম যেভাবেই হোক ইংরেজি শিখতে হবে। এরপর থেকে স্যারের প্রতি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল এবং স্যারের কোন ক্লাসই মিস করতাম না। স্যার অত্যন্ত সুন্দরভাবে ক্লাসের পড়া ক্লাসেই শেষ করে দিতেন। পড়ানোর ক্ষেত্রে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য বা চিন্তায় আবদ্ধ না থেকে সবকিছুই তিনি উজাড় করতেন ক্লাসে। সকল শিক্ষার্থীকেই তিনি সমভাবে ভালবাসতেন। কোন কিছু না বুঝলে স্যারকে সরাসরি  ক্লাসে জিজ্ঞাসা করলে তিনি সুন্দরভাবে বুঝিতে দিতেন। স্যারের ক্লাসে মাঝে মধ্যে দু’একটি ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটত। ক্লাসে আমাদের দুই চার জন তত্ত্ব জিজ্ঞাসুমনা বন্ধু মাঝে মাঝে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজি বলে নিজেকে ইংরেজ হিসেবে জাহির করতে চেষ্টা করতো। তাদের কারও কারও উদ্দেশ্য ছিল আমাদের ক্লাসে যে আটজন বান্ধবী ছিল তাদের নিকট জনপ্রিয় হয়ে ওঠা। এরা মাঝে মাঝে স্যারকে  ইংরেজিতে কিছু বিব্রতকর প্রশ্ন করতো। স্যার এতে বিব্রত বোধ করতেন না। কখনও কখনও হাসির মাধ্যমে জবাব দিতেন। প্রশ্নগুলোর বেশির ভাগই ছিল প্রেম সম্পর্কিত এবং ব্যক্তিগত। আমাদের ইংরেজি বোর্ড বইটিতে লেখা ছিল ইংলিশ বুক ফর দ্যা ইয়ংস। এক বন্ধু একদিন জিজ্ঞাসা করে বসলো স্যার আমরা যে ইয়ংস তার স্বীকৃতি ও সুযোগ আমাদের পরিবার ও সমাজ আমাদেরকে দেয়না কেন?

এরূপ বিব্রতকর প্রশ্ন। বিশেষ করে পড়া ধরার দিন থাকলে কিছু বন্ধু চেষ্টা করতো প্রশ্নের মাধ্যমে বা কোন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ক্লাস শেষ করা। স্যার বিষয়টি বুঝতে পেরে একদিন এই ইংরেজদের আসল রূপ বের করার জন্য ইংরেজি ট্রানস্লেশন ধরা শুরু করলেন। এদের একজন কে জিজ্ঞাসা করলেন বলোতো "আমার একটি গাভী আছে এর ইংরেজি কি?” সে কোন রকম চিন্তা না করেই বলল "মাই হ্যাভ এ কাউ"। এর পর থেকে এই বন্ধুকে সবাই নাম ধরে ডাকার পরিবর্তে সম্বধোন করতো মাই হ্যাভ এ কাউ হিসেবে। আমাদের আর এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন বলোতো "আমি দুধ দিয়ে ভাত খেয়েছি"। সে উত্তরে বললো স্যার "মিল্ক টু ম্যাংগো"। এ বন্ধুর অবস্থাও মাই হ্যাভ এ কাউ এর মতো হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে যখন গাইবান্ধা সরকারি কলেজে যোগদান করি। স্যারের সাথে কুড়িগ্রামে কলেজ মোড়ে দেখা স্যার বললো আমি গেজেটে তোমার নাম দেখেছি। আমি স্যারকে কদমবুসি করলাম। স্যার বললেন একজন ছাত্র যখন শিক্ষকের সমপর্যায়ে আসে তখন শিক্ষকের আর আনন্দের সীমা থাকেনা। আমার আজকের দিনের অনুভূতিও এরকমই। এরপর কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে যোগদান করার পর স্যারের সাথে প্রতিনিয়তই দেখা হতো। আমি ইংরেজি কোন বিষয় না বুঝলে স্যারকে জিজ্ঞাসা করতাম। স্যার এ ক্ষেত্রে আগের মতো সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলতেন অমুক বইটি পড়ে নিও তাহলে তুমি সঠিক উত্তর পেয়ে যাবা। ২০১২ সালে কুড়িগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ থেকে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করি। স্যার তখন অবসরে থাকার পরও শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের  অনুরোধে ইংরেজি বিভাগের ক্লাস নিতেন। আমি পরবর্তীতে  উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বপালনকালীন সময়ে হঠাৎ একদিন স্যারের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পাই। সকল সহকর্মীর সাথে পরামর্শ করে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানানোর জন্য স্যারের মরদেহ কলেজ প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়। অসংখ্য বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী স্যারের প্রতি অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। আমিও একজন শিক্ষক হিসেবে স্যারের মাঝে যে নিয়মানুবর্তিতা, সততা ও অপূর্ব শ্রমশীলতা দেখেছি তা আমার সারা জীবনের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হিসেবে চিরন্তন আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?