‘অতলে জীবন’ গল্পগ্রন্থের লেখক আহসান হাবীব জুলকারনাইন কুড়িগ্রাম জেলার সন্তান হলেও চাকুরীসূত্রে গাইবান্ধায় ছিলেন ১৯৯৩ হতে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। চাকুরীর পাশাপাশি সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় তিনি গাইবান্ধাবাসীর সঙ্গে মন উজাড় করে মিশেছেন। কুড়িগ্রাম জেলায় তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে ছোটবেলা থেকেই সম্পৃক্ত। নাটক লেখা ও নির্দেশনার কাজেও তিনি যথেষ্ট পারঙ্গম। চাকুরীসূত্রে বিভিন্ন গ্রাম, হাট-জনপদ ও চরাঞ্চলে ঘুরে বেরিয়েছেন দীর্ঘদিন। এই সমাজের বাস্তব দর্শনই তাঁর লেখার মূল উপজীব্য। ‘উত্তরের চর’, ‘নিস্তরঙ্গ’, ‘জাত’, ‘হাইটালি’ ও ‘অতলে জীবন’ শিরোনামে পাঁচটি ছোটগল্পে সাজানো আটচল্লিশ পৃষ্ঠার গ্রন্থটির নাম ‘অতলে জীবন’।
‘উত্তরের চর’ নামক গল্পে চরাঞ্চলের মানুষের দুঃখের জীবনগাঁথা ফুটে উঠেছে আইয়ুব আলীর নদীতে জাল ফেলে মাছ না পাওয়ার বর্ণনায়। নদীতে চর জেগে ওঠার কারণে পানি যেমন নাই, তেমনই মাছও নাই। পাড়ার ভাতিজা রহিম উদ্দীনের সাথে কথোপকথনে উঠে এসেছে সরকারের দায়িত্বহীনতার কথা। ‘উত্তরের চর’ গল্পে আইয়ুব আলীর মতো দুঃখ-কষ্টে ভরা জীবন রহিম উদ্দীনেরও। তারা মনের দুঃখে অভিমানে এসবকে নসিবের লিখন হিসেবেই মনে করেন। দেলোয়ারের বউকে ফাঁকি দিয়ে চাকুরী দেবার নামে পাচার করে নিয়ে যাওয়া ক্ষুধা ও দরিদ্রপীড়িত মানুষের আরেক মরণ। চরের নোংরা রাজনীতি, জাল কেনার টাকার জন্য মহাজনের কাছে ঋণ নিয়ে শোধ করতে না পারায় সুদের টাকার চক্রবৃদ্ধির চিন্তা, সর্বনাশা নদী ও ক্ষুধা দারিদ্র থেকে মুক্তির চিন্তা, আইয়ুব মিয়ার সংলাপ ও চিন্তার মধ্য দিয়ে জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে গল্পে। গল্পগুলি পড়লে চোখের সামনে যেন প্রতিটি কাহিনীর চিত্র ভেসে ওঠে।
লেখকের আরেক গল্প ‘নিস্তরঙ্গ’, এখানে উঠে এসেছে মঙ্গাপীড়িত মানুষের দুঃখ-কষ্ট-হাহাকার। ক্ষুধার্ত নাবালক ছেলেকে সাথে নিয়ে বাবা বেগুন নিয়ে হাঁটে চলছিলো দ্রুতপদে। কারণ বেলা গড়িয়ে যায়, বাড়িতে একমুঠো চালও নাই। হাট শেষ হলে কে কিনবে বেগুন? কীভাবে সে কিনবে চাল? দুখী কৃষকের যা হয় এদেশে! হাটে গিয়ে দেখে, বেগুনের দাম পানির দামে। করিমুদ্দিন মধ্য দিয়ে এ হাটের বর্ণনা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একদিকে মঙ্গা অন্যদিকে কৃষকের উৎপাদিত সবজির ন্যায্য দাম না পাওয়া সমাজের প্রকৃত চিত্র লেখক খুবই সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন ‘নিস্তরঙ্গ’ গল্পে।
অতলে জীবন |
লেখকের আরেক গল্প ‘জাত’। এই গল্পটি পড়লে বাংলার মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের সেই বিখ্যাত কথাগুলিই মনে পড়ে, যা মানব-ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ বাণী- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য- তাহার উপরে নাই।’ হরিজন সম্প্রদায়ের মেথর বাবুলাল ও তার স্ত্রী দু’জনেই বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে খুব ছোট পদে চাকুরী করেন। তাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি যেমন ছিল, পাশাপাশি ভালোবাসাও ছিল। বাবুলাল যে টাকা আয় করে তা মদের পেছনেই শেষ করে ফেলে। আর তাই বাসন্তী যে টাকা আয় করে তার উপরে নজর পড়ে বাবুলালের। এজন্য বাসন্তী বাবুলালকে অপছন্দ করে।
প্রকৃতপক্ষে সমাজে এ চিত্র শুধু বাবুলাল ও বাসন্তীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; অনেক চৌধুরী বংশে, সৈয়দ বংশে বা ধনী মানুষদের ক্ষেত্রেও যে দেখা যায়, লেখক হয়তো আক্ষেপ করে তাঁর লেখায় বাবুলাল ও বাসন্তীর মাধ্যমে সেই চিত্রই তুলে ধরেছেন। বাসন্তী জাত-পাত মানে না। সে ভাবে, জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ এসব মানুষেরই তৈরি। মানুষের যা যা থাকে, সবই তার আছে। জ্ঞান বুদ্ধিও অনেকের চেয়ে কম না। তার পরেও সে নিচু জাত কেন? কিন্তু সমাজ যে বৈষম্য, বিভেদ, বর্ণ, ধর্ম তৈরি করেছে সেটা বোঝার ক্ষমতাও বাসন্তীর আছে। বাসন্তী তার স্বামী বাবুলালের কাছে প্রায়ই নির্যাতিত হয়। তারপরও সে অফিসের চাকুরীতে ঝাড়ু দিতে যায় প্রতিদিন। একই অফিসের নাইট গার্ড আকরামের সাথে সুখ-দুঃখের কথা বলে। এভাবে আকরাম মনে মনে বাসন্তীকে ভালোবেসে ফেলে। একদিন গ্রামের মেলায় বাসন্তীর সাথে দেখা হয় আকরামের। রোমান্টিক কিছু কথাও হয় তাদের মধ্যে। এ কথা বাসন্তীর স্বামী বাবুলাল জানতে পেরে বাসন্তীকে প্রচণ্ড মারপিট করে। মার খেয়ে দিশেহারা অবস্থায় অফিসে ঝাড়– দিতে এসে আকরামকে নালিশ করে এবং পরামর্শ চায়। আকরাম তখন তার ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিয়ে তার উপর ভরসা রাখতে বলে। পরবর্তীতে বাবুলালের অতিরিক্ত মদ খাওয়া ও বাসন্তীকে গালি দিয়ে বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, আকরাম ও বাসন্তী জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বিয়ে করেছে। এই গল্পের মাধ্যমে লেখক জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণের বিরুদ্ধে এক বৈষম্যহীন ও মানব ধর্ম প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত দিয়েছেন নিঃসন্দেহে।
লেখকের আরেকটি গল্পের নাম ‘হাইটালি’। মূলত এটি একটি নদীর নাম। এই নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে সুবর্ণপুর গ্রামের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রা। জেলেদের জীবিকা নির্বাহসহ সকল উৎসবই হাইটালি নদীকে কেন্দ্র করে। এই গল্পে তিনটি নাম এসেছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা নিয়ে। একটি হচ্ছে গ্রামের নাম সুবর্ণপুর, যেখানে ছিলো সুন্দর প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য, ছিলো মেলা, পৌষ-পার্বণে উৎসবমুখর সর্বক্ষণ। শৈশবের এই স্মৃতি এখন যার কাছে নস্টালজিয়া হিসেবে দেখা দিয়েছে সে ছিলো গ্রামের দূরন্ত মেয়ে কাজল। সুবর্ণগ্রাম, কাজল ও হাইটালি নদী এ তিনটি নাম গল্পের রসদ উপাদান হিসেবে যেন চোখের সামনে ভেসে আসে। এটি এমনই এক ট্রাজেডিক গল্প, যা আমাদের দেশে এখনও বিরাজমান। অবিরাম বর্ষায় সুরুজের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে, পরিবার পরিজন নিয়ে না খেয়ে আছে। কার্তিক মাসের আকালে মহাজন কাদের মোল্লার কাছে গিয়েছিলো সুরুজ ১০ কেজি ধান কর্জ করার আশায়। কিন্তু মহাজন পর মৌসুমে ২০ কেজি ধান পরিশোধ করার শর্ত দিলে সুরুজ আলীর আর কর্জ করা হয়নি। অবস্থা যখন আরও চরমে তখন সুরুজ আলী বাধ্য হয়ে বর্ষার মধ্যে খাল-বিলের পানি পেরিয়ে মহাজন কাদের মোল্লার বাড়িতে যায় এবং তার পা জড়িয়ে ধরে সাহায্য চায়। কিন্তু কাদের মোল্লা চরম অপমান করে সুরুজকে ফিরিয়ে দেয়। অতঃপর সুরুজ দুর্বিসহ জীবন নিয়ে দুঃখে কষ্টে অতলে ভাসতে থাকে। একদিন সমাজের এই মহাজনী মানুষদের শোষণ-নিপীড়ন ও ধর্মকে পুঁজি করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি অপরদিকে দারিদ্র্যপীড়িত অভাবগ্রস্ত মানুষের হাহাকার লেখক নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন ‘অতলে জীবন’ নামক গল্পে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?