যুদ্ধার্থীগণ পুনশ্চতেও কাতরায় - মাহফুজুল ইসলাম শামীম

যুদ্ধার্থীগণ পুনশ্চতেও কাতরায় - মাহফুজুল ইসলাম শামীম

প্রধানত কবি তিনি। কাব্যের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন করতে করতে ছোটগল্পের ডিঙি নৌকোয় পা দিলেন মিজান খন্দকার (১৯৬০-২০২১)। আশা তাঁর-`পুনশ্চ যুদ্ধার্থী'গণ নামবে যুদ্ধে, স্বাধীনতার চেতনাকে বুকে নিয়ে গড়বে নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু `দখল' থেকে মুক্তি না পেয়ে তারা কি `ডানা' মেলে ছুটেছে শূন্যতার পানে? গ্রন্থিত চারটি গল্পে এ সত্যই তো ধাবমান।


নদী, নারী কিংবা প্রযুক্তি দখলের বয়ান...সভ্যতার সাথে নদীর প্রবহমানতা সর্বজনস্বীকৃত। নদীর নিজস্ব অন্তর্ময় ভাষাকে বিদীর্ণ করেছে সভ্যতার অনিবার্য অনুষঙ্গ প্রযুক্তি। প্রাযুক্তিক উৎকর্ষ শুধু জলের চরিত্র নয়, জলজীবনকে দাঁড় করিয়েছে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি। সুবোধ ঘোষের অযান্ত্রিক বিমল যন্ত্রের সাথে সখ্যতা গড়লেও মিজান খন্দকারের নুরুল যন্ত্রসখা হতে পারে নি। পারেনি বলেই বদরুদ্দিনের হাতে তাকে হতে হয়েছে নির্যাতিত, নিগৃহীত। কিন্তু প্রাযুক্তিক-পুঁজি জন্ম দিয়েছে যে ঘাটিয়ালের তারা কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারে নি। পরিবর্তনে সায় দিতে না পারায় অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষত নুরুলের চৈতন্যপ্রবাহে এক অনাম্নী নারীদেহের আগমন ঘটেছে সত্য, তবে খোতের সঙ্গে চাঁদের আলোয় বিক্ষোভমিশ্রিত মিলনই হয়েছে তার পরিণতি। সম্মত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভবের সূত্র ধরেই পুরুষ নারীর ওপর সমাধিকার স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছে। নদী আর নারীর দ্বৈরথে বিভক্ত হয়েছে নুরুলের সামূহিক চেতনা। `দখল' গল্পের শুরুতেই তাই চেতন-অবচেতনের অবিরাম প্রবাহে বিনষ্ট হয়েছে নুরুলের ঐতিহ্যিক অভিজ্ঞান। গল্পকারও কোনো প্রতীকী পরিচর্যায় না গিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বিবৃত করেছেন কার্যকারণ। কুড়িগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় ধরলা তীরের জীবনবাস্তবতার এ এক অনুপম আলেখ্য- `বউকে মনে পড়ে তখন, গ্রামে যখন তার বাড়িভিটা সব ছিলো, স্বচ্ছল সংসার ছিল, তখন খোতের শরীরও যৌবন-লাবণ্যে নদীর মতোই এমন ঝলমল করে জ্বলতো, ঝলসাতো। একটা দীর্ঘশ্বাস তার কলজেটাকে ধারালো ছুরির মতো ফালা ফালা করে কেটে কেরিয়ে আসে বুক থেকে।' [দখল]


কাক, পাখি আর স্বাধীনতার প্রতিবর্গীকরণ...`মানচিত্র মানে একটা দেশ, একটি পতাকা, কিছু মানুষ এবং স্বাধীনতা। আর স্বাধীনতা হলো বৃরে মতো, একটু একটু করে ফলবতী হয়ে ওঠে।'... না, আটত্রিশ বছরেও আমাদের শিশু স্বাধীনতা-চারাগাছটি বৃক্ষ হয়ে ওঠে নি, ফলবতী হওয়া তো সুদূরপরাহত আকঙ্ক্ষা। চার দশকের দৃশ্যমান বাস্তবতা এখন রূপ নিয়েছে ভয়ঙ্কর মূর্তিতে। রাষ্ট্রকাঠামোর এমন কোনো গলি নেই আজ যেখানে জন্ম নেয় নি পঁচা দুর্গন্ধময় ডাস্টবিন। সে ডাস্টবিনগুলোর নীরব দর্শক একটি বা একগুচ্ছ কাক। তিনটি পরিচ্ছদে ভাগ করে পঁয়ত্রিশটি বিচ্ছিন্ন দৃশ্যাবলীর এক কোলাজ ক্যানভাস তৈরি করেছেন মিজান খন্দকার তাঁর `পুনশ্চ যুদ্ধার্থীগণ' গল্পে। গল্পে বর্ণিত প্রতিটি দৃশ্যপটই সাদা চোখে দেখবার মতো কিন্তু অন্তর্কাঠামোর বাস্তবতা উপস্থাপিত হয় নি। কাকের চোখ দিয়ে দেখে তাতে জল জমে নি গল্পকারের। এ নির্বাক নির্মোহ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি পাঠককে মুগ্ধ করে তবে আর্থকাঠামোর স্বরূপ বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটলে পাঠক নিজেই হয়ত হতো এক একজন যুদ্ধার্থী। কেননা, দর্শক-পক্ষীকুল তো `সম্ভ্রম-বিজরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পুনশ্চ উদ্ভব হওয়া যুদ্ধার্থীগণের দিকে'ই।


জীবন যাত্রার খণ্ডচিত্র...কোচটির নাম জীবন এক্সপ্রেস। কুড়িগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু, গন্তব্য ঢাকা। ড্রাইভার কন্ডাক্টরসহ মানুষ ৩৮ জন। গল্পটির মোট চরিত্র ১৮। বাকি ২০ জনের নাম-পরিচয়-পেশা অনুল্লিখিত। কুড়িজন আরোহীর পঞ্চাশটি ভিন্ন ঘটনা প্রবাহ ও আলাপচারিতার গল্পিক ভাষ্য `একটি দূরপাল্লার কোচ ও গতির অভ্যন্তরে কিছু বহুভেদক প্রাণ'। গল্পকার গল্পটি সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছেন। বয়ানের ভাষায় কাব্যময়তা স্পষ্ট। একদিকে গর্ভবতী নারীর বাচ্চা প্রসব জীবনের ইঙ্গিতবাহী আবার পরিণতিতে মৃত্যু যেমন গাল্পিক দ্বন্দ্ব (পড়হঃৎধংঃ) তৈরি করেছে তেমনি গল্পকারের ভাববাদী দর্শনেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতি-জীবন-প্রজন্ম দ্বন্দ্ব-মফিজ চেতনার দ্বিমুখী ব্যাখ্যায়ন-পেশাভাবনা-অর্থনীতি-সমাজচেতনা-ফ্যাশনাবেশ-জৈবিক প্রবৃত্তির সামষ্টিক দর্পণ হয়ে আছে গল্পটি। পেশার সঙ্গে ভাষার বহুমুখীনতা গল্পটির প্রাণ। নিরীক্ষাপ্রবণ গল্পের প্রথাগত পরিসমাপ্তি গল্পটির শিল্পসৌন্দর্য্য ক্ষুন্ন করলেও সর্বজ্ঞ লেখকের ঘটনা পরিবীক্ষণের স্থান ও কাল পাঠককে প্রশ্নের মুখোমুখি ঠেলে দিয়েছে।

সাবিত্রী আর জোবেদার আর্তচিৎকার...বীভৎস সমাজের পাশবিক হিংস্রতার হাত থেকে রক্ষা পায় নি তাঁরা। `ওমার নাম আল্দা, ধর্ম আলদা, কিন্তুক ওমরা জাতে এক। ওমরা রাখাল হয়া সাবিত্রীকে পোড়ায় মারে, সোবহান হয়া জোবেদার শরীলে আগুন ধরে দিয়া মারি ফ্যালে। ওমার আলাদা কোনো জাত নাই।'এই বেজাতি পুরুষতন্ত্র, ধান্ধাবাজ নারীবাদী, পঙ্গু সংবাদপত্র (মিডিয়া?), নোংরা সমাজপতি, অশ্লীল আইন, জঘন্য রাষ্ট্র, পকেটভারি এনজিও, আখের গোছানো স্বেচ্ছাসেবী, কিংবা বিকৃত মুক্তনারী... কেউই থামাতে পারে নি সাবিত্রী আর জোবেদার আর্তচিৎকার। পুড়েছে, মরেছে তবু পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে দেখিয়ে দিয়েছে ক্ষতস্থানগুলো। কোনো সংঘ-সমিতি-আইন তাদের মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে নি; এ যেন আঠারো শতকীয় অন্ধকারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষ। গল্পকার দেখেছেন এবং লিখেছেন সেভাবেই। গল্প নয়, স্মৃতিদৃশ্যপট উন্মোচন করেছে সত্য ঘটনার এবং সমাজব্যবস্থার প্রতিই একটা বিবমিষা জাগিয়ে তুলেছে পাঠকের। দৃশ্যপট যখন আমাদেরই সমাজের একটা করুণ নোংরা ঘা-য়ের তখন শৈল্পিক গঠন হয়ে পড়ে গৌণ। তবে প্রতিবাদ নেই কেন কোথাও? তবে কি এ সমাজ নির্লিঙ্গদের আস্তাবল? হতে পারে। যে কারণে গল্পকার বলেন- `তথাপি এ কাহিনী শেষ হয় না' এবং একথাও সত্য বলে প্রতীতী জন্মায় যে-`রৈখিক ধ্বনির সব চিৎকার মৃত্যুর মতোই...'। তবে আসুন মিজান খন্দকার-এ সমাজটাকেই ছুঁড়ি ফেলি। জল আর কাদামাটির নতুন প্রতিমা দিয়ে গড়ে তুলি এক মানবিক কাব্যময় সমাজ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?