০১.
কবিতা আমার কাছে কবির দর্শন যতটা মনে হয়, তার চেয়ে বেশি মনে হয় জীবনের দর্পণ! আমি কবিতায় ডুবে গিয়ে কেবলি ভাব দর্শনে ভিজে যাইনা বরং কবিতা দর্পণে নিজেকে দ্যাখার যে আনন্দ, যেটা পেতে মরিয়া হয়ে উঠি, এতেই আমার স্বস্তি! পড়ুন, কি সহজ ভাষায় সরলতার সাথে কবি বলেন -
রহমান চাচা প্রায়ই বলতো
মৃত্যু খুব আপন তার কাছে।
রেল লাইনের অংক সে বুঝত না-
বাগধারার শব্দ সে জানতো না-
জমির মামলা, জুম্মার নামাজ, সন্ধ্যায় উলুধ্বনি, পুলিশের গন্ধ, ককটেলের রঙ ইত্যাদি
কিংবা
আরও অনেক ইত্যাদি-
সে কিছুই চিনতো না ভালো করে
(প্রলাপ)
এমন দর্পণে নিজেকে ভাসিয়ে দেবার যে আনন্দ সেটা অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই! জীবনের অর্থ না বোঝা অতি সাধারণ এক মানুষ মৃত্যুকে ভাববেন এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু কবিতার ভাষায় সহজিয়া প্রাণের যে কথা সে কথা গাথুনিতে বেঁধে রাখা অতি সহজ সাধ্য নয়। ভাষার জটিলতায় অনেকেই ভীত হয়ে ওঠে আবার ভাষায় মাধুর্য্যতায় অতি তুচ্ছ কথাও গেঁথে যায় কানে, প্রাণে। এখানেই কবির মোড়লিপনা! কবি সেই মাধুর্য্য ভরা ভাষার স্রষ্টা! কবি শুভ্র সরখেল সেই সহজিয়া প্রাণের কথায় গড়ে তুলেছেন কবিতার মহাজগত। আমরা কি তাকে ফেলে দেব নাকি খুঁজে নেব- এ দায় আমাদের। কবির কাজ সৃষ্টিতে মগ্ন থাকা, শুভ্রর মগ্নতা আমাকে ছুঁয়ে যায়।
০২.
কবিতা মানেই জটিল অংক কষার খেলা নয়। এখানে আবেগের যতটা মিশ্রণ সাথে যাপিত জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতার ফসল! অন্যদিকে আমার কেবলি মনে হয়, বেদনাময় স্মৃতি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, শঙ্কা, দুর্ভাবনাগ্রস্থ জীবনের যে পলায়নপরতা কিংবা নিজেকে ভুলিয়ে রাখায় যে প্রয়োজনীয়তা, সেটার সবচেয়ে ভাল মাধ্যম কবিতায় ভেসে যাওয়া বা ডুবে থাকা। মায়ের মতন স্নেহ দিয়ে কবিতা ছাড়া আর কে আছে সংসারে কবিকে আগলে রাখার! তাই হয়তবা কবি সত্য আওড়ে যান কবিতায়…
আমার একটা মৃত্যু দরকার
দূরন্ত মৃত্যু।
বাহকের সারথি হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতে হয়
হায় আমার কৃষ্ণ!
তুমি আমার প্রেম যদি একবার দেখতে-
হয়তো আবার প্রেম করার জন্য বকুল ফুলের গাছ হয়ে যেতে।
বকুল ফুলের মৃত্যু দরকার-
দূরন্ত মৃত্যু।
(আমার একটা মৃত্যু দরকার)
অন্যদিকে, উপমা বর্জিত কবিতা কিংবা বলা যেতে পারে সরল রৈখিক ভাষায় কবিতা সাজানোর যে প্রচেষ্টা সেটা দেখা যায় শুভ্র সরখেলের কবিতায়। কবি যখন বলেন-
বকুল ফুলের মৃত্যু দরকার-দূরন্ত মৃত্যু।
খুব সহজে পাঠকের মননে গেঁথে যায় সে বাক্যের ইতি বৃত্তান্ত... এখানে শব্দের খোঁজে, বাক্যের গঠনতন্ত্রের সূত্রের খোঁজে পাঠককে মরিয়া হয়ে উঠতে হয় না। পাঠক এখানে নিজেই তার বিস্তৃত মনের জানালা খুলে বুঝে উঠতে সক্ষম বলেই আমার মত। আবার যখন, “কলার পাতায় সত্য উপনিষদ”
কবিতায় কবি বলেন-
আমার তো ওই বালের ব্যালেন্স টুকোই নেই!
এখানে এসে পাঠকের মনে হতে পারে, কবিতায় শব্দের ব্যবহারে কবির অসচেতনতা ভেসে উঠছে...। নাহ! আমি বলি কি, ভাবুন এভাবে, মুখের ভাষা যে কবিতা হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ পেয়ে যাই আলোচ্য কবিতাংশে! মানুষের মুখের ভাষা কিংবা সংবাদপত্রের ভাষা কবিতা নয়। এগুলো কবিতা হলে কবিতাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রয়োজন বোধ জন্মাত না। বরং বলা যায়, কবিতার কিছু লাইন মুখের ভাষার মতোই লাগে। কিছু-কিছু কবিতার লাইন মানুষের মুখের ভাষার সাথে, চেতনার ভাষার সাথে, বোধের সাথে, অভিজ্ঞতার সাথে, প্রত্যাশার সাথে এতোই মিলে যায় যে, কবিতার ওই লাইনটি প্রবাদে পরিণত হয়। তাহলে মুখের ভাষার সাথে কবিতার ভাষার দূরত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো? কিংবা ধরুন, রিকসাওয়ালার কন্ঠে যখন কবি বলেন,
পেডেল মাইরা কি চান্দে যাওন যায়!
তখনও দার্শনিকতার স্পর্শে সচেতন হয়ে ওঠে মন। সীমাবদ্ধতা ও প্রত্যাশার বিপরীতার্থকতাও ভেসে ওঠে। কিন্তু কথাটি তো নিছক মুখের ভাষা-ই। কিংবা বুদ্ধদেব বসু যখন বলেন,
সোনালী আপেল, তুমি কেমন আছো?
অথবা শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন বলেন,
যেতে পারি- কিন্তু কেন যাবো?
তখন? তাহলে দেখা যাচ্ছে মুখের ভাষাও তার প্রচলিত অর্থকে ছাপিয়ে বিশেষ অর্থ বহন করতে পারে। তেমনি কবিতার ভাষাও মানুষের মুখের ভাষা হয়ে যেতে পারে। কবিতার বিশেষত্বও এখানেই। একটি শব্দকে সাধারণভাবে উপস্থাপন করলে সে সাধারণ অর্থই প্রকাশ করবে বা আভিধানিক অর্থই প্রকাশ করবে। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ যদি আভিধানিক অর্থকে অতিক্রম না করতে পারে তাহলে বলতে হবে কবি তার ভাবকে শব্দের নদীর মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারেনি। আবার সাধারণ মুখের ভাষাকেও সাধারণ অর্থ থেকে উপরে তুলে তাকে বিশেষ অর্থে অর্থায়িত করা যায়। তখন মুখের ভাষাও হয়ে ওঠে কবিতা।
০৩.
কবি শুভ্র সরখেলের কবিতার ধরণ, সাথে তার কবিতাকে নিয়ে অপকটে কথা বলার ধরণ প্রায় একই ধাঁচে বাঁধা। কবিতা নামক প্রেয়সীকে সে যেমন অন্যধাঁচে সাজিয়ে তোলে তেমনি কবিতার প্রতি তার প্রবল ভালোবাসা বোধ বোঝা যায় ‘বিন্দু’তে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে। “কবিতা আপনার কাছে কি?” এমন প্রশ্নের উত্তরে শুভ্র বলেন-
কবিতা আমার কাছে ফালতু একটা ব্যাপার, যাকে আমি যেকোন সময়, যেকোনভাবে, যেকোন পরিস্থিতিতে ভালবাসতে পারি।
শব্দের আড়ালে যে ভাবার্থ আমাদের অনুসন্ধানী করে তোলে অর্থাৎ গোটা বাক্য থেকে একটি-দুটি শব্দের অর্থ বা ভাবার্থ উহ্য করে আমরা যদি ভাবতে থাকি তাহলে কবিতার প্রতি কবির প্রবল ভালোবাসা বোধ আমাদেরকে জাগিয়ে তোলে। খুব তুচ্ছ করেও যে ভালোবাসা যায় সেটা কবি শুভ্র সরখেলের কাছে শিখতে আমার লজ্জা হয় না বরং আমি খুঁজে পাই আমার আর এক সত্ত্বাকে।
কবির কবিতার ভাষা ভিন্ন বলে গণ্য হয় তখনি, যখন কবি তার পূর্বসূরিদের কবিতার ভাষা থেকে নিজেকে ভিন্নভাবে প্রকাশের শক্তি অর্জন করেন। কবিতা সৃজনে কবির তৃতীয় চোখের (অনুভবের চোখ) প্রখরতা যেমন স্বীকৃত তেমনি কবি মনের চেতন বা অবচেতন শক্তিসমূহ এক উজ্জ্বল মুহূর্তে তাদের দুজনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কবিতাকার লাভ করে দৃশ্যের সৃষ্টি করে। এ কারণে হয়ত বাংলা কবিতা প্রকৃতিসম্ভূত হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। শুভ্র সরখেলও দৃশ্যের সৌন্দর্য মন্থন করে কবিতার ভাঁজে-ভাঁজে নিসর্গপ্রেমের কথা তার কবিতায় ফুটিতে তুলেছেন... ‘সত্য প্রেম’ কবিতায় কবি দৃশ্যের বর্ণনা করেন এভাবে,
জলের উপর তোমার মুখের ছায়া
কলাগাছের পাতায় দেখেছি অনেক আগেই-
তোমার মুখ কলা গাছের পাতায় দেখা যায় অনেক অদ্ভুত।
জীবনের এই বেলায় এসে আমার ব্যক্তিগত মত এই যে, কবিতা কারবারীদের অধিকাংশই একসাথে মিলেমিশে 'একটি কবিতা’ লেখার চেষ্টা করে চলেছেন, তখন কাউকে স্বতন্ত্র কবি হিসেবে চিহ্নিত করার কাজটি কঠিন হয়ে ওঠে। খোলাভাবে বললে, বাংলা কবিতায় ত্রিশ দশকের কবিদের আধুনিকতা, পৃথক কবিতাভাষা থেকে শুরু করে ইউরোপীয় কবিতার প্রভাব ও প্রকরণ এখনো বাংলা কবিতাকে ঘিরে রেখেছে, সেখানে মাত্র কয়েকজন তরুণ নিজ পথে হাঁটছেন। কবিতার প্রয়োজনে ভাষা শৈলিকে যেমন নিজের মত করে দেখছেন, তেমনি উপমা বর্জন করে ভাষার শিল্পীত ব্যবহার করছেন। শুভ্র সরখেল সেই তরুণদের একজন।
ভালো থাকুক শুভ্র সরখেল নামের নতুন নক্ষত্র!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?