কবির মানসসঞ্জাত আবেগের শিল্পিত রূপ কবিতা। একজন ব্যক্তি নিজের অনুভূতির অন্তরালে যে অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি সঞ্চিত করেন তা যদি তাঁর রচনায় শিল্পরূপ ধারণ করে তাহলে তিনি উপভোগ করেন কবিত্বের আনন্দ। ধরলা নদীর বিস্তীর্ণ কোলে বসে মিজান খন্দকার অনুভব করেন তাঁর মর্মলোককে। চরাচরে ব্যপ্ত চিত্রপট তিনি চেনেন এবং বোঝেন, তাঁর দর্শনবোধের বিশেষ মাত্রা রূপ পায় বাস্তবতায়, তাই তিনি নিঃসঙ্গ পায়চারী করেন নিবিড় নৈসর্গে। তাঁর ‘যথাকবি নিরঞ্জন’ কাব্যটি আমাদের চেতনায় এই বার্তাই পৌঁছে দেয় যে ধরলাপ্রেমী কবি সমকাল ও আধুনিকতাকে ধারণ করতে পেরেছেন। পাদপ্রদীপের কাঙাল নন তিনি। তাই অনুষঙ্গের মৌলিকত্ব তাঁর প্রধান সহায়।
আপাতদৃষ্টিতে মানুষের জীবনযাত্রা এলোমেলো পথপ্রবণ হলেও তা একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী। কালে কালে সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু মানুষ সহজে হার মানতে নারাজ। বিপ্লব, বিদ্রোহ, সংগ্রামে মানুষ জয় করতে চেয়েছে জীবনসীমানাকে।
মিজান খন্দকার তাঁর আনন্দ, বেদনা, ইতিহাসবোধ, বিজ্ঞানচেতনা, রাষ্ট্রিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সমুন্নত রাখতে পেরেছেন। তিনি পুরাণকে অস্বীকার করতে চাননি। তিনি ইতিহাস ঘেঁটে বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ শেষে সত্য চিনে ফেলেছেন। তাই রূপক উপমার অনবদ্য ব্যবহার মিজান খন্দকারের প্রধান সহায়। চিত্রকল্পের আধুনিক ও শিল্পীত নির্মাণ তাঁর কবিতাগুলোকে ভিন্ন রূপ দান করেছে। অনুষঙ্গের বৈচিত্র্য তাঁকে স্বকীয় করেছে। পৌরাণিক ও বিশেষায়িত চিত্রকল্পের বিপুল বৈভবে মিজান খন্দকারের প্রতিভা অনস্বীকার্য। তাঁর উপমা তথা চিত্রকল্পগুলো আমাদের সামনে কবিতার এক নতুন শরীরকে পরিচিত করে তোলে। নতুন স্বাদ ও সৌগন্ধে তাঁর কবিতাগুলোর অবস্থান বাংলাসাহিত্যে সুনির্দিষ্ট।
তিনি স্বদেশের অন্তর্জ্বালা বুঝতে পারেন। চারপাশের অসঙ্গতি তাঁকে ব্যথিত করে। তিনি ইতিহাসের ভুলগুলোকে শোধরাতে চান। প্রত্নতাত্ত্বিক বাস্তবতার আলোকে নির্মাণ করেন একবিংশ শতাব্দীর আনন্দলোক। ধনী-গরীব, নারী-পুরুষ প্রভৃতি সামাজিক ও জৈবিক শ্রেণীবিভাগের বারান্দা পেরিয়ে তিনি অবগাহন করেন সাম্য ও মৈত্রীর সুশীতল সরোবরে। তিনি জানেন জীবন বিকাশের জন্য প্রয়োজন জীবনের স্পর্শ। কোন মতবাদ বা আদর্শের মায়াজাল, সোনালী হাতছানি তাঁকে আর মোহমুগ্ধ করেনা। হেলাল হাফিজের ‘ভুল নেতাদের জনসভা' মিজান খন্দকার চেনেন। নেতৃত্বের ব্যর্থতা তাকে কোন সান্তনা দেয়না। তাই কোন আদর্শেই আর তার আস্থা নেই। তিনি বরং মানুষের অন্তর্লোক উন্মোচিত করার কথা বলেন। নিজের মন ও সংস্কৃতির গভীরে অন্বেষণ করতে চান। কোন অজুহাতেই তিনি নিজের মর্মবোধকে বিক্রি করেননা। কারণ তিনি জানেন আজ হোক কাল হোক একদিন সত্য উদঘাটিত হবেই। শত মিথ্যার প্রলোভন ও হিংস্র বাঁধা পেরিয়ে মানুষের জয় হবেই। নতুন দিনের নতুন সূর্য সেই উদয়ের প্রত্যাশায় আছে এ প্রত্যয় তাঁর রয়েছে। আর সেই সাহসেই তিনি ‘ফেরৎ পাঠাচ্ছে নদী মানুষের পরিজন, শোকপরিবাহী জল' কবিতায় অকপটে উচ্চারণ করেন-
বহুদূরে নিরপেক্ষ আলো, উজানের দিকে ছুটতে ছুটতে
প্রতিফলিত হচ্ছে বধ্যভূমির আশে পাশে।
মূলত উত্তরে যে ধরলা নদী-
তার সমসাময়িক জল
অবিরত ছুটে যাচ্ছে আজ এক জন্মদৃশ্যের অনুসন্ধানে।
তিনি সচেতনভাবেই বধ্যভূমির কথা উচ্চারণ করেন। কারণ ১৯৭১ সালেই আমরা পেয়েছি আমাদের স্বতন্ত্র্য পরিচয়। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই আবিষ্কার করতে পেরেছি নিজেদের অন্তর্গত শক্তিকে। বাংলাদেশী রাজাকারদের সাথে নিয়ে পাকিস্তানীরা এ দেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে মেরেছিল। পাশবিক জান্তব উল্লাসে মেতে উঠে খুন করেছিল শিক্ষক, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সহ মেধাবী বাঙালিকে। তাদের লাশগুলো কোনরকম ধর্মীয় সম্মান ছাড়াই এক জায়গায় গাদা করে পুতে ফেলা হয়েছিল। এভাবেই সমগ্র বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল হাজার হাজার বধ্যভূমি। আজ আমরা যখন ’৭১ এর কাহিনী ভুলতে বসেছি তখন মিজান খন্দকার আমাদেরকে সচেতন করতে চেয়েছেন। সতর্ক করেছেন আমাদের অজ্ঞানতা ও বিস্মৃতি প্রবণতাকে।
মিজান খন্দকার জানেন ১৯৭১ আমাদের জীবনে অনেককিছু হলেও সব নয়। সম্পূর্ণ বাঙালিকে চিনতে হলে পুরাণের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। পুরাণের ছায়াতেই খুঁজে পাওয়া যাবে আত্মজ স্বকীয়তাকে। নৃতত্ত্বের নিগুঢ় বিশ্লেষণে ফিরে পাওয়া যাবে হারিয়ে ফেলা আমার আমিকে।
তারপর তাম্রভস্ম ওড়ালেই হবে দৃশ্য
লুপ্ত হাড় আদি ও জটিল
সে প্রাণের শিলাধর্ম খুঁড়ে যদি পাও মর্ম
নিজ দেহে পাবে অন্ত্যমিল। (সূত্র)
স্বাধীনতার ফল যা হবার কথা ছিল তা হয়নি। সাতচল্লিশ এর গহ্বরে যে অপশক্তি লুকিয়ে ছিল। এখন তারা প্রকাশ্যে বের হয়ে এসেছে। হিংস্র মুখ ব্যাদান করে স্বাধীনতাকে গ্রাস করতে চাইছে। কবি সময়ের দিকে সচেতন দৃষ্টি রাখেন। এখন প্রয়োজন বোধ করছেন পরিবর্তনের। তাই লোককথার বীরপুরুষকে আহ্বান জানাচ্ছেন, তাকে সাদরে গ্রহণ করার বার্তা দিচ্ছেন; সেই বীরপুরুষের হাতে বিধ্বস্ত দেশের পুনরুদ্ধার প্রত্যাশা করছেন। কবি লোকজ ভাসান গানের আঙ্গিকে লোকজ কাহিনীর আলোতে ইতিহাস বিধৃত করছেন। রূপকথার শেষ দৃশ্যের মতো স্বৈরশাসকের পরাজয় ও গণমানুষের পুনরুত্থান প্রত্যাশা করছেন।। (ভাসান)
শ্রেণী সচেতনতা মিজান খন্দকারের বিশ্বাসে আমূল গ্রন্থিত। মানুষের মধ্যে অন্য সব কিছুর চেয়ে শাসক ও শাসিতের সম্পর্কটি যে অন্যতম সে বোধ তাঁর প্রকট। তিনি এর বিলোপ চেয়েছেন। তিনি চান শাসকের সৌধ ধ্বংস হোক। আর এ কাজটিতে পাশে ডাকেন শোষিত শ্রেণীটিকেই। মার্কসীয় দর্শনে আস্থা রেখে তিনি আদর্শ সমাজের সৌন্দর্য চিনে ফেলেছেন। তাই কবিতার শরীর তুলে আনেন স্বদেশের তৃণমূল মানুষঘেঁষা লোকজ পুরাণ থেকে। ঐ তৃণমূল মানুষদের মনে আশার সঞ্চার করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন। রূপকথার সমাপ্তি সুখকর হলেও বাস্তবের সমকালীন লোককথা খুব নির্মম। এখানে বৈষম্য ও ব্যর্থতাই সত্য। শাসকের আস্ফালনের সামনে আমরা অসহায়, পরাজিত। তাই আধুনিক লোকগল্পটির সূচনা চিরায়ত হলেও শেষাংশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
সোনার পালঙ্কে কন্যা জাগিয়া উঠিল
শিয়রে অচিন এক যুবক দেখিল।
..............................................
মন্ত্রগুণে রাক্ষসেও শুনিল সে কথা
উড়িয়া পৌঁছাইল সে মায়া নদী যেথা।
নীলবর্ণ মৎস্যখানি কাটিল তক্ষণে
জন্মিল রাক্ষস আরো মহাবিস্ফোরণে।
সেই পুঁথিগত গল্পের মায়া নদীর কূল থেকে
বিস্ফোরণজনিত তীব্র তরঙ্গ
ধেয়ে এসে আঘাত হানছে
আজ এই বঙ্গরাষ্ট্রে, আকাশের সুবোধ বাতাসে। (ফেরৎ পাঠাচ্ছে নদী মানুষের পরিজন, শোকপরিবাহী জল)
আধুনিক যুগে এখন আর কেউ কবি হয়ে জন্মায়না। প্রতিদিনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহ, প্রেরণা, বেদনা, উৎসাহ, প্রতিবাদ, পর্যবেক্ষণ, শ্রম, অভিজ্ঞান মিলেমিশে একজন মানুষ ধীরে ধীরে কবি হয়ে ওঠেন। তাকে নিত্যদিন নিরন্তর আত্মবিশ্লেষণ করতে হয়। আবিষ্কার করতে হয় আত্মজ অনাবিস্কৃত দিগন্ত, যন্ত্রণার দায় ও মানবিক সৌকর্যকে। মিজান খন্দকার নিজের মর্মকে বিশ্লেষণ করতে দ্বিধান্বিত নন। তিনি নিজেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অবলীলায় বলেন-
অসম প্রণয়ে হয়েছি অসঙ্গত
ক্রমশঃ চৈত্রকে করেছি মর্মগত।
..................................
যে দেহ প্রতিভা দেখালে অগোচরে
সে দৃশ্য প্রেরণা ছড়াল এ অন্তরে। ( কবি)
তবে তিনি কবির স্বরূপ বোঝেন। কবির দায়িত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে তিনি সচেতন। পার্থিব জীবনের শত ব্যর্থতা ও আশাভঙ্গের বেদনা মিজান খন্দকারকেও আর্ত করে তোলে। তিনি দেখেন-
পশ্চিমপ্রবণ বায়ু হতে কতো ধর্মযুদ্ধ,
বাণিজ্য সন্ত্রাস এবং নিবিড় মেদের গদ্য
ছড়িয়ে পড়ছে
ফসলের নব-উদ্ভাবিত প্রকরণে। (যথা কবি নিরঞ্জন)
ফলে দেশের সমাজের আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে যায়। মানুষের পতন ঘটে অন্তসারশূন্য মহাকালীক গহ্বরে। ক্ষয়ে যায় প্রাত্যাহিক প্রতিবেশ ও সার্বিক মূল্যবোধ। মানুষের অস্তিত্ব ধরে নাড়া দেয়। সর্বব্যাপী আক্রমণাত্মক ‘পশ্চিমপ্রবণ বায়ু’ তারপরও সফল হতে পারেনা।
কেননা বিধানবর্জিত এমন দিনে
ভূ-গভীর থেকে উঠে আসছে আজও কাব্যপ্রণোদনা। (যথা কবি নিরঞ্জন)
সূত্র: গ্রন্থগত ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহিত। লিংক যথা কবি নিরঞ্জন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
মন্তব্য করার আগে আর একবার চিন্তা করুন, যা বলতে চান তা যথার্থ কি?